বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

পরপারে এক মুক্তিযোদ্ধা ও দ্বাদশ নির্বাচন

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:৩৭, মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
  বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা আমার অভিপ্রায় নয়। তাই মনস্থির করেছি এবার দাঁড়াব। জানি না আর কদিন বাঁচব, সখীপুরের মানুষ আমায় সারা বিশ্বে তুলে ধরেছিল, আমিও তাদের প্রাণভরে ভালোবেসেছি। সখীপুরে আমার কাছে কোনো দল-মত নেই। সবাইকে আপনজন মনে করি। শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই মনে করে যাব। আমি চাই একটি সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন। দেশের মালিক জনগণ, দেশের মালিক ভোটাররা যাতে তাদের মালিকানা ফিরে পায় এটাই আমার আন্তরিক কামনা। সারা জীবন বঙ্গবন্ধুকে অন্তরে লালন করেছি, পালন করেছি, ধারণ করেছি। তাঁকে আদর্শ হিসেবে মেনেই এই জগৎ সংসার থেকে চিরবিদায় নিতে চাই। 

আর মাত্র দুই দিন পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন। একাদশের মতো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হলে তা হবে জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক। এর আগে একবার ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে ছিলেন। ওরকম হলে আমাদের আর মুখ দেখাবার কিছু থাকবে না। কেন যেন মাঝে মাঝে সাগরের ঢেউয়ের মতো জীবনের উথাল-পাথালের কথা মনে হয়। 

’৭৫-এর ১৪ আগস্ট রাতেও আমাদের সবকিছু ছিল। কিন্তু সকালে ফকির, এতিম হয়ে গিয়েছিলাম। ২৬ তারিখ রবিবার আওয়ামী লীগ তাদের মনোনয়ন দিয়েছে। কতজনের কত লাফালাফি মুহূর্তে সব শেষ। যে লতিফ সিদ্দিকীর হাত ধরে টাঙ্গাইলের প্রায় সবাই রাজনীতিতে এসেছিল, তার গাড়ি ভেঙেছিল ভোটারবিহীন সংসদ সদস্য হাজারী। কোনো বিচার-আচার হয়নি, কোনো প্রতিকার হয়নি। নমিনেশন না পেয়ে আজ সে পথের ভিখারি। গুন্ডাপান্ডা কিছুই আর তার কাজে আসবে না। অন্যদিকে সখীপুরের এমপি জোয়াহের হঠাৎই কী করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। এ অঞ্চলে কাদেরিয়া বাহিনী ছাড়া একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিল না, থাকার উপায় ছিল না। অথচ কোনো দিন যার কথা শুনিনি, সে হঠাৎই মুক্তিযোদ্ধা। টাঙ্গাইল-৮ থেকে সে মনোনয়ন পায়নি, পেয়েছে শওকত মোমেন শাজাহানের ছেলে জয়। 

বোনের যাকে ভালো লেগেছে তাকে দিয়েছেন। তার দল তিনি যা ইচ্ছা করবেন, ঠেকাবে কে? যদিও এটা গণতন্ত্র নয়, কিন্তু এখন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলে গেছে। নানা কারণে গত তিনবার ভোটে দাঁড়াতে পারিনি। নানা ষড়যন্ত্র নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অমনটা হয়েছে। এমনকি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকীকে ভোটে দাঁড় করিয়েছিলাম। মানুষ তাকে প্রাণভরে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ওর ইচ্ছা নেই রাজনীতিতে থাকার। ঠিক আছে, কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা আমার অভিপ্রায় নয়। তাই মনস্থির করেছি এবার দাঁড়াব। জানি না আর কদিন বাঁচব, সখীপুরের মানুষ আমায় সারা বিশ্বে তুলে ধরেছিল, আমিও তাদের প্রাণভরে ভালোবেসেছি। সখীপুরে আমার কাছে কোনো দল-মত নেই। সবাইকে আপনজন মনে করি। শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই মনে করে যাব। আমি চাই একটি সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন। দেশের মালিক জনগণ, দেশের মালিক ভোটাররা যাতে তাদের মালিকানা ফিরে পায় এটাই আমার আন্তরিক কামনা। সারা জীবন বঙ্গবন্ধুকে অন্তরে লালন করেছি, পালন করেছি, ধারণ করেছি। তাঁকে আদর্শ হিসেবে মেনেই এই জগৎ সংসার থেকে চিরবিদায় নিতে চাই। ইমানের সঙ্গে চিরবিদায় নিতে পারলে সেটাই হবে আমার জন্য আনন্দের।

আসা-যাওয়ার দুনিয়ায় কেউ কিছু বলতে পারে না কখন কার ডাক পড়ে। তাই অনেক সময় অনেক অশান্তি ভালো লাগে না। শান্তি-অশান্তি সে তো আমাদের নিত্যসঙ্গী, কমবেশি থাকবেই। কিন্তু অকারণ অশান্তি বড় বেশি যাতনা দেয়, আঘাত করে। অন্যের দুঃখে যদি দুঃখিত হতে না পারি তাহলে তো জন্মই বৃথা। অন্যের হাসি-কান্না হৃদয়ে ধারণ করা সেই তো মানুষের কাজ। কিন্তু তা আমরা পারছি কই। ২৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। আগে কোনো অবরোধে গাড়িতে উঠতাম না। এবারের অবরোধে আমার কোনো সমর্থন নেই। তাই অবলীলায় গাড়িতে উঠি বা চলি। সেদিন এক প্রখ্যাত নেতা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযোদ্ধা বোন শেখ হাসিনার একসময়ের তথ্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী সাঁথিয়ার অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এসেছিলেন। ফোনে বলেছিলেন, ‘অবরোধ, গাড়ি বের করব কী করে?’ আমি গাড়ি পাঠিয়েছিলাম। কারণ জনাব আবু সাইয়িদের অতীত আছে, ইতিহাস আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ভারতে অবস্থানকালে মেঘালয়ের তুরা যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে আমার বাবা-মা শিলিগুড়ির যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে বহুদিন ছিলেন। অনেক সেবাযতেœর পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। 

সেই অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে তো কিছুটা সম্মান জানাতেই হয়। তাই গাড়ি পাঠিয়েছিলাম। সেদিন ছিল বুধবার। বৃহস্পতিবারে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। যখন কোনো বাধা-নিষেধ থাকে না তখন রাস্তার যে অবস্থা, অবরোধে রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় স্বাভাবিক সময়ের চাইতে চার-পাঁচ, এমনকি আট-দশ গুণ বেশি। জানি না, বিএনপির এ অবরোধ কেন? গাড়িঘোড়া পরিচালনায় যারা জড়িত তাদের সে যে কি দুরবস্থা কেউ ভেবে দেখে না। গাড়িঘোড়া যখন চলে তাদের পরিবার-পরিজন রাজার হালে থাকে। কিন্তু অবরোধে সবকিছু বন্ধ হওয়ায় তাদের তো তুন্দলনাস্তি, হাঁড়ি চলে না। কাকে বলব এসব কথা? সেদিন আবার ওয়ানডে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া জিতেছে, ভারত হেরেছে। 

আগে তৃণমূলেরই ছিলেন, এখন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির বিরোধীদলীয় নেতা। বারবার বলছেন, আমরা বাংলাদেশ বানিয়ে দিয়েছি। ছোট মানুষ বড় কথা বললে বড় বেশি খারাপ লাগে। বাংলাদেশ বানিয়ে দেওয়ার কারও কোনো মুরোদ ছিল না। যিনি বলছেন সে সময় তার নাম-গন্ধও ছিল না। ভারতের পরাজয়, অস্ট্রেলিয়ার বিজয়ে বাংলাদেশের কিছু ক্রিকেটপ্রেমী নাচানাচি করেছে। সব দেশে সব জাতিতে কমবেশি কুলাঙ্গার থাকে। ভারতে যেমন আছে, আমাদের দেশেও আছে। এ নিয়ে অবশ্যই পুরো একটি লেখা লিখব। ভারতের এখনকার গজিয়ে ওঠা নেতারা যদি ভাবেন যে তারা খুব বেশি দয়া করেছেন তাহলে তাদের ইতিহাস জানা নেই। রক্ত অত সহজ নয়। আমরা লাখো কোটি মানুষ রক্ত দিতে পেরেছিলাম বলেই বাংলাদেশ মুক্ত স্বাধীন হয়েছে।

এটা কারও দয়ার দান নয়। স্বীকার করি, নিশ্চয়ই মহান ভারতের অভাবনীয় সহযোগিতা পেয়েছি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পেয়েছি, ভুটান প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল এর কোনো কিছুই আমাদের ভোলা উচিত নয়। দেশের আপামর জনসাধারণ যাদের বোঝার তারা কেউ এটা বলেনি। কিছু মানুষের লাফালাফিতে নেতা হয়ে অত বড় কথা বলা শোভা পায় না, বরং ভারতের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়।

আমার জীবন মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে। মুক্তিযুদ্ধ না হলে, আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমায় দয়া না করলে আমি আজ অন্ধকারের অতল গহ্বরে থাকতাম। আমার এতদূর আসার কোনো কলাকৌশল ছিল না, কোনো বিরাট ভূমিকা নেই। একজন মানুষ হিসেবে দেশবাসীকে হৃদয়ে ধারণ করে যখন যা করা যায় তখন তাই করার চেষ্টা করেছি, এখনো করি। মুক্তিযুদ্ধটা ছিল মস্তবড় পরিবর্তনের একটা বিষয়। যুদ্ধের শুরুতে যারা ছিলেন, যুদ্ধে তারা ছিলেন না। সবাই জীবন বাঁচাতে নানা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

 অল্প বয়সে যখন হানাদারদের মা-বোনের ইজ্জত হরণ করতে দেখেছি, হত্যা করতে দেখেছি তখন সহ্য করতে পারিনি, পালিয়ে না গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছি। একেবারে নাম না জানারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের একজন আলহাজ আবদুল মালেক ২৪ নভেম্বর শুক্রবার প্রত্যুষে আমাদের মায়া কাটিয়ে সে পরপারে চলে গেছে। বড় বেশি কষ্ট লাগছে আলহাজ আবদুল মালেকের হঠাৎ করেই চলে যাওয়া। এই তো কদিন আগে বাটাজোর আঙ্গারগাড়ার হায়দার ও অন্য কয়েকজনকে নিয়ে টাঙ্গাইলের বাসায় এসেছিল। স্বপ্নেও ভাবিনি এভাবে হুট করে মালেক চলে যাবে।


মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় ঢাকার পিলখানা থেকে কিছু ইপিআর অস্ত্রশস্ত্রসহ কালমেঘার ইলিমজান উচ্চবিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল। আমি তাদের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে কিতাব আলীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, যা সারা জীবন অটুট আছে। আশ্রয় নেওয়া ইপিআরদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। এক সপ্তাহের জন্য তাদের কাছ থেকে সময় নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল ঘুরে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে পাহাড়ে ফিরে দেখি কে বা কারা মান্না তালুকদারকে মেরে চলে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলাম। পায়ে হেঁটে কাওরাইদ, বরমী, মাওনা, ফুলবাড়িয়া আরও কত জায়গায় ছোটাছুটি করেছিলাম, কিন্তু তাদের কোনো পাত্তা পাইনি। হতাশ হয়ে আড়াইপাড়ার বিএ মৌলভী বাড়িতে বসেছিলাম। বিএ মৌলভী একজন নামকরা মানুষ, টাঙ্গাইলে তার বিরাট ব্যবসা। ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তা তাকে বলা যায়। আমার সঙ্গে সিলেটের ছোট্ট ফারুক আর যেন কে কে ছিল। 

এমনি একসময় বিকালের দিকে হামিদুল হক বীরপ্রতীক, খোরশেদ আলম আরও এবং শওকত মোমেন শাজাহান নানাদিকে খোঁজখবর নিতে ছুটে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎই হামিদুল হক এসে খবর দেন, ‘পাওয়া গেছে’। কী পাওয়া গেছে? ‘না, চারজন যোদ্ধা পাওয়া গেছে।’ একটু পর সে চারজনকে নিয়ে আসা হয় আমার কাছে। তখন আমি আড়াইপাড়া বাজারে। চারজনের কাছে চার চার ষোলটা রাইফেল, না হলেও চার দুগুণে ৮ হাজার গুলি, একটা টু ইঞ্চি মর্টার, একটা বা দুটা বেরি লাইট আমার সামনে এনে যখন রাখা হলো মনে হলো এ যেন এক হিমালয় পাহাড়। মালেকের কাছ থেকে জানলাম আঙ্গারগাড়া পরশুরাম মেম্বারের বাড়িতে ইপিআররা সব অস্ত্র লুকিয়ে গেছে। লোক পাঠানো হলো সেখানে। তখন আমার সঙ্গে ছিল মনির কমান্ডার, কামার্থীর সাইদুর আরও বেশ কয়েকজন। তারা সন্ধ্যার একটু পর আঙ্গারগাড়া রওনা হয়ে গভীর রাতে পরশুরাম মেম্বারের বাড়ি থেকে প্রায় ১০ মহিষের গাড়ি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে।

 আড়াইপাড়া আমরা অন্য গাড়ি ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাতে তুলে কচুয়ার দিকে রওনা হই। বড়চওনা থেকে ইদ্রিস কমান্ডারের সহায়তায় ১০ গাড়ি কচুয়ায় রাখা হয়েছিল। কচুয়ায় আর অস্ত্র বদল না করে শুধু গাড়ির মহিষ বদল করে নিয়ে যাওয়া হয় বর্তমান কাদেরনগর মুজিব কলেজ আঙিনায়। ধুমঘাটের সালাম ফকির সে এক অসাধারণ মানুষ। যিনি মুজিব কলেজের জন্য ১০-১৫ একর জমি দিয়েছিলেন। আরও অন্যরাও দিয়েছিলেন। তবে তার দেওয়ার কোনো তুলনা হয় না। সেই সালাম ফকির, খোরশেদ আলম আরও, হামিদুল হক, শওকত মোমেন শাজাহানের অভাবনীয় কৃতিত্বে সব অস্ত্র এখানে ওখানে লুকিয়ে রেখে আমাকে এক অসাধারণ নিখুঁত তালিকা দেওয়া হয়। ৩ এপ্রিল সাটিয়াচরা যুদ্ধে আমাদের পক্ষের ইপিআর এবং ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র যোদ্ধারা পিছিয়ে গেলে টাঙ্গাইল পুলিশ কোথা থেকে আমি নানা ধরনের ৭০-৮০টা অস্ত্র নিয়ে মরিচা-বাঘেরবাড়ি-ছোটচওনা হয়ে বড়চওনা গিয়েছিলাম। সেই অস্ত্রগুলো হাওয়ার মতো লুকিয়ে রেখেছিল বড়চওনার কৃতী পুরুষ ইদ্রিস কমান্ডার, মোক্তার ও কালিয়াপাড়া ঘোনারচালার খোরশেদ মাস্টার।

 

পুনঃগঠিত হয়ে আমরা যুদ্ধ শুরু করলে অসাধারণ ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতায় অস্ত্রগুলো আবার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর ইপিআরদের তিন-সাড়ে তিন শ রাইফেল, স্টেনগান, এলএমজি, টু ইঞ্চি মর্টার, রকেট লাঞ্চার, যুদ্ধে সংকেত দেওয়ার জন্য বেরিলাইট কাদেরিয়া বাহিনীকে প্রথমদিকে অস্ত্র সুসজ্জিত করতে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই ভূমিকায় আবদুল মালেক ছিল এক অসাধারণ যোদ্ধা। আবদুল মালেক, রাজ্জাক সিদ্দিকী, সাবদুল এবং আরেকজন যার নাম এখন মনে পড়ছে না সেদিন আমাকে, আমার বাহিনীকে সাগরে ডুবন্ত জাহাজের মতো টেনে তুলেছিল। এরপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত গেছে। ১১ আগস্ট যমুনার মাটিকাটায় কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানিদের এক মস্তবড় বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিল। তাদের গোলাগুলি বোঝাই দুটি জাহাজ কাদেরিয়া বাহিনী দখল করে নিয়েছিল। সেটা ছিল বর্ষাকাল। গ্রামেগঞ্জে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার জন্য আমাদের কোনো কিছু করতে হয়নি। শুধু পানিতে ছেড়ে দিলেই হলো।

 জাহাজ থেকে উদ্ধার করা বিপুল অস্ত্র যার বলতে গেলে একটিও খোয়া যায়নি যেটা কাদেরিয়া বাহিনীকে অস্ত্রবল এবং মনোবলে বিরাটভাবে শক্তিশালী করে তুলেছিল। সেই হাজী আবদুল মালেক হঠাৎই আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছি। সামনে একটি জাতীয় নির্বাচন, বেঁচে থাকলে কত কাজ করত। তাই বুকের ভিতর বড় বেশি তোলপাড় করছে, শান্ত হতে চেষ্টা করছি, ভুলে যেতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। পরম দয়ালু আল্লাহ কোনো নিকটজনের মৃত্যুতেও বেশিক্ষণ মন খারাপ করতে বারণ করেছেন। কারণ সব মৃত্যুই আল্লাহর ইচ্ছা। তাই আল্লাহর ইচ্ছাকে অস্বীকার বা আল্লাহর ইচ্ছা নিয়ে মনে কোনো দুঃখ রাখা উচিত না। মালেক কিন্তু শুধু ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেনি, সে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ যুদ্ধেও দারুণ ভূমিকা রেখেছে। তাই মালেকের কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছে, কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

 

দেশে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের উত্তেজনা। বিএনপি গো ধরে আছে, তারা বোন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা এটা বলতেই পারে। কিন্তু অবরোধ দিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করতে পারে না। অবরোধ ডাকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই অবরোধে সবাই যদি সাড়া দিত তাহলে সেটা ছিল ভিন্ন কথা। সাধারণ মানুষের কোনো সাড়া নেই। এর আগেও একবার অবরোধ ডেকেছিল, মনে হয় আজ থেকে ছয়-সাত বছর আগে। সে সময় ডাকা অবরোধ বিএনপি বা বিএনপি জোট প্রত্যাহারের সুযোগ পাননি। প-িতরা বলছেন, সরকার জোট ভাঙার চেষ্টা করছে। সরকারের যা যা করার তা তারা করবেই।

 

সরকারে থাকার জন্য তাদের যদি মাথা নিচে দিয়ে হাঁটতে হয় তাও তারা হাঁটবে-এটাই রাজনীতির কথা, এটাই ন্যায় ও সত্যের কথা। শক্তিশালী জনপ্রিয় বিরোধী দল থাকলে সরকার এমন বেপরোয়া হতে পারত না, প্রশাসনও লাগামহীন হতে পারত না। এ জন্য সরকারের দায়ের চাইতে বিরোধী দলের দায় খুব একটা কম না। বিরোধী দল সব বিরোধীদের নিয়ে একত্র  এগোতে পারছে না। বিরোধী দলের দেশের জন্য চিন্তা নেই। সব চিন্তা ক্ষমতায় যাওয়ার। এ তো কোনো রাজনীতির কথা নয়। একদিকে বিএনপি বিদেশি সমর্থনে সবকিছু দখল করে নেবে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের এখনো ধারণা নৌকা পেলেই তারা বিজয়ী হয়ে যাবে। সত্যিকার অর্থে মানুষ ভোট দিতে গেলে এবং ভোট দিতে পারলে অনেক নেতার সুন্দর উজ্জ্বল মুখ কালো হয়ে যাবে।

Share This Article