তারেক-ফখরুল দ্বন্দ্বের নেপথ্যে!

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ দুপুর ০১:০৮, শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২২, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪২৯
  • প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন ফখরুল
  • জামায়াত নিয়ে মতপার্থক্য
  • তারেকপন্থীদের দাপট ও বেয়াদবি

 

প্রতিটি নির্বাচনের আগে বা দলীয় বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মানসিক চাপে ভোগেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে প্রায়শই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধীতায় জড়ান তারা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাঝের সম্পর্কটিও যে এমন দ্বন্দ্ব, অনাস্থা ও অবিশ্বাসের দোলাচলে প্রবহমান তা আর গোপনীয় নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরেই তাদের এহেন সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট হতে শুরু করে।

দ্বন্দ্বের শুরু হয়েছিলো যেভাবে:  

২০১৮ সালে তারেক রহমানসহ দলের অধিকাংশ নেতাই নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মির্জা ফখরুল ও ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেন নির্বাচন বর্জন না করে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু ড. কামাল তারেক রহমানকে আশ্বস্ত করেন যে, ৩০ ডিসেম্বর দেশে ভোট বিপ্লব হবে। আর এটিই তারেক রহমানের মূল মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠে।  

প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন মির্জা ফখরুল!:            

২০১৮ সালের সেই নির্বাচনে বিএনপি যদি  কিছু আসনও পেত তাহলে বিরোধী দলের প্রধান হতেন মির্জা ফখরুল। আর কোনওভাবে যদি দলটি বিজয়ী হতো তবে সাজাপ্রাপ্ত বেগম জিয়া ও পলাতক তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিজয়ী দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হতেন মির্জা ফখরুল। আর এ কারণেই মির্জা ফখরুল সেই নির্বাচনে এক সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামালের নেতৃত্বেও নির্বাচনে যেতে অতি আগ্রহী ছিলেন বলে মনে করতেন তারেক। এটি মানতে পারেননি তিনি। তাই লন্ডন থেকে বিভিন্ন প্রার্থীকে টেলিফোন করে নির্বাচনী কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে বলেন। নির্বাচনের দিন মহাসচিবকে না জানিয়েই ৪৪ প্রার্থী ভোট বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। আর শতাধিক প্রার্থী নীরবে কর্মীদের ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে নেন। মির্জা ফখরুল বিষয়টি জানতে পারেন এবং তারপর থেকে দুজনের মাঝে যে তিক্ততা শুরু হয়েছিল তা আর কমেনি।  
                          
নির্বাচনী জোট নিয়ে দ্বন্দ্ব:  

২০১৮ সালের নির্বাচনে ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি।ঐক্যফ্রন্ট গঠনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিশেষ আগ্রহ ও অবদান ছিল। কিন্তু ভোটে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর তার জন্য ড.কামালকে দায়ী করার পাশাপাশি খোদ বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা এমনকি তারেক রহমানও মির্জা ফখরুলকেও দায়ী করেন।

এর পর থেকেই মির্জা ফখরুলের ওপর সন্দেহ ও অবিশ্বাস জেগে ওঠে এবং তাকে সরকারের এজেন্ট বলে গালি শুনতে হয়েছে নিজ দলীয় নেতা কর্মীদের মুখ থেকেই। আর এতে তারেক রহমানের সন্দেহ থেকেই যে এমন কথা বিএনপিতে চাউর হয় সেটি মির্জা ফখরুলের বুঝতে কষ্ট হয়নি। ফলে তারেক-ফখরুল দুরত্ব আরো প্রকট হয়।

কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব:

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গতবছর থেকেই বিএনপি ঘর গোছানোর লক্ষ্যে কমিটি পুনর্গঠনে হাত দিলে আবারও তারেক- ফখরুলের সেই পুরাণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে সময় মানিকগঞ্জসহ অন্তত ১০টি জেলা বিএনপির কমিটি চূড়ান্ত হয়ে এসেছিলো লন্ডন থেকে। কিন্তু এই কমিটির ব্যাপারে মির্জা ফখরুল কিছুই জনতেন না। ফলে তিনি এই কমিটি নিয়ে ঘোর আপত্তি তুলেছিলেন।

মির্জা ফখরুলের বক্তব্য ছিল, যারা দলের জন্য কাজ করছেন, তাদেরকে বাদ দিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক দিয়ে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তাই যে কমিটি তারেক দিয়েছিলেন  সেই কমিটির প্যাডে স্বাক্ষরও করেননি মির্জা ফখরুল। অথচ এ কমিটিগুলোর ব্যাপারে অনড় অবস্থানে ছিলেন তারেক রহমান।

এমনকি ওই সমস্ত কমিটি নিয়েও স্ব স্ব জেলায় অসন্তোষও দেখা দিয়েছিল। এরপর জেলা কমিটিসহ প্রায় সকল রকম কমিটি গঠনেই মির্জা ফখরুলের মতামত অগ্রাহ্য করা হলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ফলে তারেক রহমানের সাথে মির্জা ফখরুলের দ্বন্দ্ব ও দূরত্বের বিষয়টি অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে আসে।
                                               
জামায়াত নিয়ে মতপার্থক্য:  

জামায়াতের প্রতি  তারেক রহমানের দুর্বলতা দলের অনেক নেতাকর্মীর মত মির্জা ফখরুলও ভালোভাবে নিতে পারেননি। তারেক রহমান মনে করেন রাজপথে জামায়াত বিএনপির বিশ্বস্ত ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। মূলত নিজ দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আস্থা না থাকায় তারেক জামায়াত শিবিরকে কাছে পেতে চান সব সময়। কিন্তু মির্জা ফখরুল এ বিষয়ে তারেক রহমানের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন।

বলা হয় মির্জা ফখরুলের কারণে সম্প্রতিক সময়ে জামায়াত বিএনপি থেকে দূরে সরে যাওয়ায় তারেক ফখরুলের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে মির্জা ফখরুল আবার রাজপথের শক্তির চাইতে বিদেশি শক্তির আশীর্বাদের প্রতি আস্থাশীল ও মনোযোগী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তারেক-ফখরুল কেউই নিজ দলের প্রতি আস্থাশীল না থাকায় বিকল্প পথে হাঁটার যে কৌশল নিয়েছিলেন তাতেই দুজনের মধ্যকার সম্পর্ককে আরো বৈরী করে তোলে।

তারেকপন্থীদের দাপট ও বেয়াদবি:

বিএনপিতে খালেদাপন্থী ও তারেকপন্থী নামে দুটি গ্রুপ বা বলয় তৈরি হয় খালেদা জিয়ার শাসনামল থেকেই। হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক নেতারাই তারেকপন্থী বলয় তৈরী করে। অন্যদিকে সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন খালেদা জিয়ার প্রতি অনুগত। কিন্তু তারেক জিয়ার দাপট ও ক্ষমতার অপব্যবহারে অনেক শীর্ষ নেতাই সেসময় তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন।

শোনা যায়, তারেক রহমানের কারণেই বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও অলি আহমদের মতো নেতাদের দল ত্যাগ করতে হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হবার পরও তারেক ও তার অনুসারীদের দাপট কমেনি বরং আরো বৃদ্ধি পায়। মির্জা ফখরুলসহ অধিকাংশ সিনিয়র নেতাই খালেদা জিয়ার অনুসারী হওয়ায় তারেক এর অনুসারীরা ফখরুলসহ সিনিয়র নেতাদের দলে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেন।

এমনকি বিভিন্ন কর্মসূচি বা বৈঠকে সিনিয়র নেতাদের সাথে তারেকপন্থী নেতাদের বেয়াদবির ঘটনাও হরহামেশাই ঘটে থাকে। বিশেষভাবে তারেকপন্থী হিসেবে পরিচিত রিজভী আহমেদ ও আমানের সাথে মহাসচিব মির্জা ফখরুলের মধ্যে প্রায়ই এমনটি ঘটে। প্রকাশ্যে পাল্টাপাল্টি প্রেস কনফারেন্স'র মাধ্যমে বিপরিতমুখি বক্তব্য দিতেও দেখা যায় তাদের। এসবই তারেক রহমানের ইশারায় ঘটে বলেই মনে করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফলে তারকের  প্রতি তার ক্ষোভ তীব্রতর হতে থাকে।      

সরকারের সাথে আঁতাতের অভিযোগ:

মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে বিএনপিতে সবচেয়ে বড় যে অভিযোগের ডালপালা গজিয়েছে তা হলো সরকারের সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল ও সত্যিকারের আন্দোলন গড়ে না তোলা। ২০১৮ সালে ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রণ্ট গঠনে তার অতি আগ্রহ প্রকাশের পরেই এমন অভিযোগ দানা বাঁধে যা নির্বাচনে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর আরও স্পষ্ট হয়।

নিজ দলের অনেকেই মনে করেন মির্জা ফখরুল সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তি, প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পছন্দ করেন এবং এ কারণেই মাঝে মাঝে তিনি তার খোঁজ খবরও নেন। মির্জা ফখরুল অসুস্থ হবার পর প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলে সরকারের সাথে তার আঁতাতের তত্ত্বটি দলে আরও বেশি চর্চিত হতে শুরু করে।

অনেকেই বলে থাকেন প্রায় সময়ই রাত ১২ টার পরে তিনি বাসায় থাকেন না। সে সময় তার ফোন বন্ধ থাকে। গভীর রাতে তাকে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার অফিস থেকে বের হতেও দেখা গেছে। মূলত মির্জা ফখরুলের ওপর সরকারের সাথে গোপন আঁতাতের বিষয়টি দলে এখন ওপেন সিক্রেট।

সম্প্রতি নিজ দলের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার পক্ষে 'ফখরুল হটাও' শিরোনামে তারেক রহমানের কাছে একটি পত্র প্রেরণের খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। জানা যায়,  তারেক রহমান বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। তবে মির্জা ফখরুলের বিষয়ে এমন অভিযোগের কথা তারেক  রহমান অবগত আছেন এবং তিনি তা বিশ্বাস করলেও বেগম জিয়ার আস্থাভাজন হওয়ায় এবং তার প্রতি সিনিয়র নেতাদের সমর্থন থাকায় কোনও পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি। মূলত তারেক রহমানের সাথে মির্জা ফখরুলের দূরত্ব সৃষ্টির প্রধান কারণই সরকারের সাথে গোপন আঁতাতের অভিযোগ ও আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থতা।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারেক-ফখরুল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু, আন্দোলন, কমিটি গঠন, জোট গঠন, জামায়াত ইস্যুসহ প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়েই তাদের মাঝে মতভেদ দেখা দেয়, যার প্রভাবে দলটির মাঝেও বিভক্তি দেখা দেয়।

তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাহ্যিকভাবে বিষয়টি তারেক-ফখরুল দ্বন্দ্ব মনে হলেও এটি আসলে খালেদা-তারেক দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ।

Share This Article


বিএনপিতে ফের ভারত বিরোধিতা উসকে দিতে তৎপর রিজভী: ক্ষুব্ধ সিনিয়র নেতারা!

যে তিন কারণে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে চায় বিএনপির তৃণমূল

উপজেলা নির্বাচন: ফের গণবহিস্কার বিএনপিতে!

উপজেলা নির্বাচন: বিএনপিকে ধোঁকা দিল জামায়াত!

উপজেলা নির্বাচন বর্জন : লাভের চাইতে ক্ষতি বেশি বিএনপির!

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সংকটে বিএনপি: প্রকাশ্য বিদ্রোহ!

ফের কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ: ব্রিটিশ ও মার্কিন কূটনীতিকদের তৎপরতা শুরু!

বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম কি কমেছে?

দেশের মানুষের ‘নিরাপত্তা’ নিয়ে ইউনুসের দুশ্চিন্তা: সোশ্যাল মিডিয়ায় হাস্যরস!

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন ১৭ এপ্রিল

আন্দোলন নিয়ে শরিকদের কোনো দিক নির্দেশনা দিতে পারছে না বিএনপি!

কখনোই যাকাত-ফেতরা দেননা ড. ইউনুস!