যত দেরি তত বিপদ

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ০৯:৩৪, শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২২, ১২ ভাদ্র ১৪২৯

অপূর্ব আলাউদ্দিন

‘আমার বাবা রোহিঙ্গা, আমি বাংলাদেশি।’ কথাগুলো অকপটে দাবি করছিল আট বছরের এক রোহিঙ্গা শিশু। জানতে চাইলাম, ‘তুমি বাংলাদেশি কীভাবে?’ তার ধারাল জবাব-‘আমার বাবা হইছে মিয়ানমারে, আমি তো বাংলাদেশে হইছি।’ ছেলেটি এখন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হকারগিরি করে। কখনো চা বেচে, কখনো গান শোনায়।


সমুদ্র সৈকতে বসে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, ২০১২ সালে তার পরিবার অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কিছুদিন টেকনাফ নয়াপাড়া অস্থায়ী ক্যাম্পে এক আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় নিয়ে ছিল। পরে সুযোগ বুঝে চলে আসে কক্সবাজার শহরে। এখন বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মচারীর সহায়তায় বনের জমিতে অস্থায়ী বসতবাড়ি বানিয়ে থাকছে বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার। স্থানীয় কাউন্সিল অফিস থেকে এ ছেলের নামে একটি জন্মসনদও তুলে নিয়েছেন তার বাবা।

 

২.

‘ন-জানি, ন-চিনি।’ রোহিঙ্গা সদস্যদের অধিকাংশের মুখের বুলি ছিল এ বাক্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, তদন্ত কর্মকর্তা কিংবা গণমাধ্যমের কোনো কর্মী যদি কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে কোনো রোহিঙ্গা সদস্যের বক্তব্য গ্রহণ করতে চাইত, তখন এ বাক্যটাই বেশি শোনা যেত।

আগে দোভাষী ছাড়া তাদের সঙ্গে কথা বলাও ছিল দুরূহ ব্যাপার। চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন ছাড়া তাদের ভাষা বোঝার ক্ষমতা খুব কম বাঙালিরই ছিল। এমনকি শুদ্ধ বাংলা বোঝাতেও দোভাষীর প্রয়োজন হতো। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে দৃশ্যপট বদলে গেছে। এখন দোভাষীদের চাহিদা নেই বললেই চলে।

সম্প্রতি একটি নিউজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা সদস্যের বক্তব্য গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়। ক্যাম্পের হেড মাঝি (রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা), সাব মাঝি এবং ভলান্টিয়ার সদস্যসহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা আমার সামনে। ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানোর পর এক তরুণ বলে উঠলেন, ‘শুদ্ধ ভাষায় বলব, নাকি আমাদের ভাষায় বলব?’ কথাটা এত সুন্দর বাংলায় বললেন যে তিনি রোহিঙ্গা কিনা বুঝতে আমার বেশ সময় লাগল। পরে জানলাম, উপস্থিত সবাই ভালো বাংলা বলতে পারেন।

৩.

২০১৯ সালের ২২ আগস্টে লাকী নামের এক নারী চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে স্মার্টকার্ড তুলতে গেলে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তিনি রোহিঙ্গা এবং টাকা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র করিয়েছেন।

একটি ল্যাপটপসহ গ্রেফতার করা হয় নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী জয়নালকে। মামলা হয় কোতোয়ালি ও ডবলমুরিং থানায়। একটি মামলা সিআইডি, অন্যটি তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। পৃথকভাবে কর্মচারী জয়নালের অবৈধ সম্পদের খোঁজে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক থেকে জানা যায়, একজন রোহিঙ্গাকে এনআইডি দিয়ে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা পেতেন জয়নাল। তিনি নিজেই ১ হাজার ৮৪০ রোহিঙ্গাকে এনআইডি করিয়ে দেওয়ার কথা আদালতে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন।

৪.

২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জে পাসপোর্ট করতে এসে এক রোহিঙ্গা নারী আটক হন। মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মাকসুদুর রহমান জানান, জান্নাত আক্তার নামের এক নারী পাসপোর্ট করতে আসেন। তার আবেদনে স্বামীর নাম দেওয়া হয় রেজাউল করিম। বাবা আবদুল হাই। ঠিকানা সাটুরিয়া উপজেলার ২ নম্বর দিঘলীয়া ইউনিয়নের বেঙরই গ্রাম। জন্ম ২০০০ সালের ১০ জুন।

ওই নারীর কথাবার্তায় সন্দেহ হয় পাসপোর্ট কর্মকর্তার। খোঁজখবর নিয়ে দেখেন, জান্নাত আসলে রোহিঙ্গা নারী। তার আসল নাম আসমা। বাবা সিরাজুল হক। ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর এই নারী টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত হন।

৫.

মিয়ানমারে চল্লিশের দশক থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গা জাতির ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন। বিভিন্ন সময় অত্যাচারিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে। সবচেয়ে বড় ঢল নামে ২০১৭ সালে। শুধু ওই বছর পৌনে ৮ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় মেলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩। তবে আগে আসা রোহিঙ্গাসহ এ সংখ্যা ১২ লাখের বেশি বলে ধারণা করা হয়।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মাঠ পর্যায়ের চুক্তি সই করেছিল। কিন্তু রাখাইনে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় দুই দফা তারিখ চূড়ান্ত করেও রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানোর চেষ্টা বিফলে গেছে। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আদৌ ফেরত পাঠানো যাবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারের কৌশল ধরতে না পারলে বরাবরই ব্যর্থ হবে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা। কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষার মিল থাকায় মিয়ানমারের জান্তা সরকারের দাবি, তারা সবাই বাঙালি। অথচ যত দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ভাষার তত পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে এনজিও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রোহিঙ্গারা শুদ্ধ ভাষা বুঝতে ও বলতে সক্ষম হচ্ছে।

কক্সবাজারে নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করতে গেলে খুব সতর্কভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়। সেজন্য রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের আবেদন করছে। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে গরমিল পেলেই ধরা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। কিন্তু এখন তো অনেক রোহিঙ্গা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। নাম-পরিচয় গোপন রেখে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করা যে কঠিন কাজ ছিল, সেটি এখন ভাষার কারণে অনেকটা সহজ হয়ে উঠছে।

আর আমাদের লোভী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মচারীরা তো আছেই। মানিকগঞ্জের সেই আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রামের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ঘটনা দুটি আবিষ্কার করেছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলার পর। বুঝতে পেরেছিলেন, তারা রোহিঙ্গা। কিন্তু শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে বুঝবেন কীভাবে? তাহলে কি রোহিঙ্গারা বাঙালির মূল স্রোতে মিশে যাবে?

অপূর্ব আলাউদ্দিন : সাংবাদিক

বিষয়ঃ রোহিঙ্গা

Share This Article