জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থায় জয় বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সন্ধ্যা ০৭:০৮, রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২২, ১৪ কার্তিক ১৪২৯

কোনো বৈশ্বিক ফোরামের নির্বাচনে জয়ী হওয়া একটি দেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তঃরাষ্ট্রীয় মানবাধিকার সংস্থার সদস্যপদ অর্জন আরো বহুগুণ কৃতিত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ২০২৩-২৫ মেয়াদের জন্য ৪৭ সদস্যের মানবাধিকার সংস্থার সদস্য হিসেবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। সাতটি আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬০টি ভোট পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৬ সাল থেকে পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশ এই মর্যাদা অর্জন করেছে। ইতোপূর্বে ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এ সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে।

 

এবারের জয় অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এমন এক সংকটময় সময় ও প্রেক্ষাপটে এ বিজয় এসেছে, যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের সমালোচনা তুঙ্গে। এমনকি বিদ্যমান মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ নতুন নিষেধাজ্ঞা বা নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে চলেছে বলেও নানা ধরণের আলোচনা উঠছে। এছাড়াও, কোভিড-১৯ মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বৈত সঙ্কটের কারণে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এসব নানা আলোচনার মধ্যেও এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশ কিভাবে অভূতপূর্ব জয় পেল? আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অঙ্গনে বাংলাদেশের অতীত ও সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার দিকে ফিরে তাকালেই এ সাফল্যের পিছনের কারণগুলো বোঝা যাবে।

জন্মলগ্ন থেকেই মানবাধিকারের সংগ্রাম ও অঙ্গীকার

বাংলাদেশের এ অর্জনের পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল মানবাধিকার ও শান্তির প্রতি দেশটির অটুট অঙ্গীকার, যা পরবর্তী বছরগুলোতে অব্যাহত রয়েছে। এমনকি পাকিস্তান আমলেও জনগণ ও রাজনৈতিক শক্তি নিরলসভাবে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে মানবমুক্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ন্যায়বিচার ও সমতার আহ্বান জানিয়েছিল। একইভাবে, ’৭২ এর সংবিধানের মাধ্যমে মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা (ইউডিএইচআর) এবং জাতিসংঘ সনদসহ আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনগুলোতে স্বাক্ষর ও অনুমোদনের মাধ্যমে শান্তি ও মানবাধিকারের প্রতি তার সম্মান প্রদর্শন করেছে। পরবর্তীকালেও, মানবাধিকার ও শান্তির প্রতি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য আনুগত্য অটুট ছিল। তাই বৈশ্বিক মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের অপরিহার্য ও ঐতিহাসিক অঙ্গীকার এ বিজয়ের নেপথ্যে কাজ করেছে।

শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় 

বিশ্ব শান্তি ও মানবমুক্তির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিচল প্রত্যয় বাংলাদেশের এ অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির পেছনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও দর্শন সবসময়ই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। শান্তি ও মানবতায় উজ্জীবিত বিশ্বকেন্দ্রিক দর্শন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নীতির মূল ভিত্তি। ফলে সে পথ ধরেই দীর্ঘ সংগ্রাম ও মানবিক নীতির কারণে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় সদস্যপদ লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছে।

শান্তির সংস্কৃতির জন্য বাংলাদেশের প্রচারণা এবং শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান

অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে বাংলাদেশ সর্বদা শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামে, দেশটি শান্তি এবং মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নীতকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশ সবসময় জনগণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছে। শান্তি, উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের প্রতিটি উদ্যোগে প্রস্তাব পাস করা, কার্যকর করা ও যৌথ শক্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সব সময় সমর্থন দেখিয়েছে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালচার অব পিসের ঘোষণা ও কর্মসূচি’ বিষয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজুলেশন ৫৩/২৪৩ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের কালচার অব পিস বিষয়ক রেজুলেশন জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সুতরাং, বৈশ্বিক শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অব্যাহত প্রচেষ্টা এবছর বাংলাদেশের বিজয়ের একটি কারণ হতে পারে।

রোহিঙ্গা সংকট এবং বাংলাদেশের মানবিক সমর্থন

মিয়ানমারের নিগৃহীত ও বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশের উদারতা ও মানবিক সহায়তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বোঝা বাংলাদেশ নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে তাদেরকে আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহ করছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েছে। ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী শিবির পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট একটি দেশ প্রতি বছর প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখভালের জন্য। বাংলাদেশের এই মহানুভবতার কারণে ভোটাররা বাংলাদেশের ওপর আস্থা রেখেছে। 

বিশ্বব্যাপী ফোরামে নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক উপস্থিতি

মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক প্রভাব আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়। গত এক দশকে জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের মতো দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উভয় বিষয়েই দেশটির উপস্থিতি লক্ষণীয়। ক্লাইমেট জাস্টিস নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র ও নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে। দেশটি ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এবং ভালনারেবল-২০ (ভি-২০) এর চেয়ারম্যান হয়েছে। শান্তি রক্ষায় প্রতিশ্রুতি এবং অবদানের কারণে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা জাতিসংঘের ‘পিস বিল্ডিং কমিশন’ (পিবিসি) এর ইতিহাসে প্রথম নারী চেয়ারম্যান হয়েছেন। ডি-৮ অর্থনৈতিক সহায়তা সংস্থা এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন- এর মতো আন্তঃআঞ্চলিক, আঞ্চলিক ফোরামেরও নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। তাই বৈশ্বিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসী কূটনৈতিক ভূমিকার কারণে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সদস্য নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে।

আর্থ-সামাজিক ও উন্নয়নমূলক সাফল্য

গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। আর্থ-সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের জীবনমানের উন্নত করেছে বাংলাদেশ। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, প্রতিশ্রুতিশীল মানব উন্নয়নে অগ্রগতি দেশটিকে বিভিন্ন সময় বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম করেছে। জনগণের অধিকার রক্ষা ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ দেশটি এরই মধ্যে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও সাফল্য পেয়েছে। তদুপরি, নারীর ক্ষমতায়নে সাফল্য, শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি, এসডিজি, এমডিজি, বৈশ্বিক ক্ষুধা, খাদ্য ও মানব উন্নয়ন সূচক অর্জন বৈশ্বিক মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের সক্ষমতার উদাহরণ। 

মিশেল ব্যাচেলেটের সফর

গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট। সফরকালে বিভিন্ন সংস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার কথা বলেছেন ব্যাচেলেট। তবে সফর-পরবর্তী প্রকাশিত প্রতিবেদনে মানবাধিকার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের আস্থার বিষয়টি ফুটে ওঠে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যার প্রভাব ছিল বেশ ইতিবাচক। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার ইতিবাচক পর্যবেক্ষণ অবশ্যই একটি অর্জন এবং এর বিশাল প্রভাব রয়েছে। প্রতিবেদনটি আগামী তিন বছরের জন্য বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক মানবাধিকার ইস্যুগুলোর দায়িত্ব অর্পণে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর আস্থা অর্জনে সহায়তা করেছে।

অধিকার সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা

মানবাধিকারের ইস্যুগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলায় বাংলাদেশের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সাফল্যের পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে। উল্লেখ্য, ২০১৮-২০২১-এর মধ্যে পরপর দুইবারসহ বাংলাদেশ ২০০৯-২০২১ সাল পর্যন্ত চারবার ইউএনএইচআরসিতে দায়িত্ব পালন করেছে। সুতরাং প্রভূত সাহসী কাজের দায়িত্ব নেওয়ার অভিজ্ঞতা এবং রেকর্ড উভয়ই যেখানে বাংলাদেশের ঝুলিতে, সেখানে কাউন্সিলের সদস্য আর কে হবেন? মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের উদ্যোগগুলোতে বাংলাদেশের অবদানের কারণেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

পরিশেষে, ২০২২ সালের ইউএনএইচআরসির সদস্যপদ প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের বিজয়ে মূলত বৈশ্বিক মানবাধিকারের প্রতি দেশের অঙ্গীকার ও অবদানের প্রমাণ মেলে। এটি বৈশ্বিক মানবাধিকার, শান্তি ও উন্নয়নের প্রতি বাংলাদেশের ক্রমাগত অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। মানবাধিকার সবসময়ই একটি ক্রমোন্নতির বিষয় এবং বাংলাদেশে এক্ষেত্রে সর্বদাই উন্নতি করে চলেছে। মানবাধিকার সংস্থার সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সক্ষমতা ও শর্ত পূরণ করেছে। মানবাধিকার ও শান্তির জন্য দেশটির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সংগ্রাম, বৈশ্বিক অঙ্গনে সরব কূটনৈতিক উপস্থিতির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সাধারণের অধিকার সুরক্ষায় পূর্ণ অঙ্গীকার বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থায় বিজয়ে অবদান রেখেছে।

লেখক: শর্মিলী মাহজাবিন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে গবেষক। বিএসএস ও এমএসএস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Share This Article