আজ ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস

ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস আজ। ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরে কিছু বিপৎগামী পুলিশের হাতে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এ সময় সাতজন নিহত হন। এরপর থেকেই সারাদেশে এই দিনটি ‘ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।

জানা গেছে, কিশোরী ইয়াসমিন ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট মাকে দেখার জন্য ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় দিনাজপুরের কোচে না উঠতে পেরে সে পঞ্চগড়গামী একটি কোচে ওঠায় কোচের লোকজন তাকে দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে নামিয়ে দিয়ে সেখানকার এক চা দোকানির জিম্মায় দেয়। পরে নিরাপদ ও রক্ষক ভেবে ইয়াসমিনকে দিনাজপুর শহরে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ভোরে পুলিশের হাতে তুলে দেয় দশমাইলের লোকজন। তবে পথে দশমাইলের অদূরে সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে পুলিশ। পরে ইয়াসমিনের মরদেহ শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ব্র্যাক অফিসের পাশে রাস্তায় ফেলে চলে যায় পুলিশ।

পুলিশের এই পৈশাচিক ঘটনা জানাজানি হলে প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের মানুষ। কিন্তু তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো ইয়াসমিনকে পতিতা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দিনাজপুরের প্রতিবাদী মানুষ। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২৬ আগস্ট রাতে বিক্ষুব্ধ মানুষ কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকলে পুলিশ আবারও তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এ সময় হাজার হাজার জনতা কোতোয়ালি থানার সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ফেলেন। ২৭ আগস্ট বিক্ষুব্ধ মানুষ একে একে রাজপথে নেমে এসে সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি ও দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে জনতার বিশাল মিছিল বের হলে মারমুখী পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে সামু, কাদের ও সিরাজসহ নাম না জানা সাতজন নিহত হন। এ সময় তিন শতাধিক মানুষ আহত হন। পরে বিক্ষুব্ধ জনগণ শহরের চারটি পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দেন। বিক্ষোভের এ সুযোগ নিয়ে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও দুষ্কৃতকারী দিনাজপুর প্রেসক্লাব, দৈনিক উত্তরবাংলাসহ স্থানীয় পাঁচটি পত্রিকা অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দিনাজপুর শহরে জারি করা হয় কারফিউ। এ সময় টানা তিন দিন চলে কারফিউ। তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেবসহ শহরের গোটা পুলিশ সদস্যদের ক্লোজড করা হলে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তৎকালীন বিডিআর বাহিনী। পরে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক জব্বার ফারুককেও প্রত্যাহার করা হয়।

এ ঘটনায় তৎকালীন দিনাজপুর সিআইডি জোনের সিনিয়র এএসপি আফজাল হোসেন বাদী হয়ে পুলিশের এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পিকআপ ভ্যানচালক কনস্টেবল অমৃত লালকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি পুলিশের সিনিয়র এএসপি মাহফুজুর রহমান তদন্ত করে এজাহারনামীয় তিনজন আসামি এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার, পিকআপ ভ্যানচালক কনস্টেবল অমৃত লাল, তৎকালীন দিনাজপুরের পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি এসআই মাহতাব উদ্দীন, এএসআই স্বপন কুমার, এসআই মতিয়ার রহমান, এএসআই জাহাঙ্গীর আলম ও ময়নাতদন্তকারী ডা. মহসিনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করেন। তখন নিরাপত্তাজনিত কারণে ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি দিনাজপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় রংপুরে। পরে রংপুর বিশেষ আদালতে ১৯৯৭ সালে ইয়াসমিন হত্যা মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই ময়নুল ইসলাম, পুলিশ কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পিকআপ ড্রাইভার অমৃত লাল বর্মণের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে রংপুর কারাগারে তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।