খুলনায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা

তীব্র দাবদাহ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি সেচের পানিসংকট

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১১:৪০, বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩০

 আমাদের সেচের পানির তীব্র অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচের পানি থাকলে আমাদের এই দাবদাহ খুব একটা ক্ষতি করতে পারত না। খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ত মাটি ও পানি বেশি। আমাদের নদীর পানিতে লবণাক্ততা, খালের পানিতে লবণাক্ততা। আমাদের প্রয়োজনীয় জলাধার নেই। যেখানে আমরা ভূ-উপরিস্থ পানি (সারফেস ওয়াটার) ধরে রাখতে পারব। 

তীব্র দাবদাহ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সেচের পানির অভাবে খুলনা অঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া তীব্র দাবদাহের কারণে পানির স্তর দিন দিন মাটির নিচে নেমে যাচ্ছে। এদিকে তীব্র দাবদাহ ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে গত ১০ বছরে খুলনা অঞ্চলে ১২১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, তীব্র দাবদাহ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে খুলনা অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রতি আড়াই বছরে একবার বড় ধরনের খরায় আক্রান্ত হয়। এ বছর দেশে তার প্রভাব রয়েছে। মার্চের শুরু থেকেই দেশে তীব্র দাবদাহ শুরু হয়েছে। এই দাবদাহ কম-বেশি চলবে জুনের শেষ পর্যন্ত। এ সময় মাঠে বোরো ও আউশ ধানের চাষ হয়। মার্চ মাসের শেষের দিকে তীব্র দাবদাহ হলে বিশেষ করে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দীর্ঘদিন বিরাজ করলে ধানের পরাগায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। 

 

এতে ধান চিটা হয়ে যায়। এ জন্য জমিতে সব সময় পানি ধরে রাখার দরকার পড়ে। তার জন্য ভূ-উপরিস্থ পানির (সারফেস ওয়াটার) দরকার হয়। কিন্তু মার্চে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায়, পানির স্তর মাটির নিচে নেমে যাওয়ায় ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসল উৎপাদন ক্ষতির মুখে পড়েছে।

 

সূত্র জানায়, খুলনা অঞ্চলে ১ হাজার ১৮৭টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে ৬১৫টি খাল ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া আরও অনেক খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে কৃষিজমিতে। আর যে খালগুলোতে কম-বেশি পানির প্রবাহ রয়েছে-সেগুলোর স্লুইস গেট না থাকার কারণে অথবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে জমিতে লবণাক্ত পানি উঠে আসে। ফলে এই স্লুইস গেট পানি সেচের জন্য কোনো কাজে লাগছে না। উলটো লবণাক্ত পানির কারণে খেতের ফসল মরে যায়। সূত্রমতে, বর্তমানে খুলনা অঞ্চলে ৬৪৯টি স্লুইস গেট অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।


সূত্র জানায়, খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গত ১০ বছরের দাবদাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করেছে। এরমধ্যে ২০১৫ সাল, ২০১৮ সাল, ২০২১ সাল ও ২০২২ সালে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, সেচের পানি না পাওয়া ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ১২১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বোরো ও আউশ ধান, পাট ও শাকসবজি। ঐ সময় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৫০ মেট্রিকটন ফসল। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২ কোটি ৬১  লাখ  ৪৯ হাজার ১০০ টাকা। এছাড়া উক্ত সময়ে ৫ হাজার ৭৭ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

 

সূত্রমতে, ২০২২ সালে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায়, বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে শুধু বাগেরহাট জেলায় ১০১ হেক্টর জমির বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

 

ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর গ্রামের কৃষক সাদেক আলী বলেন, ‘ধানে পানি দিতে পারছি না। পানির অভাবে সেচ দিতে না পারায় ধান মরে যাচ্ছে। পানির লেয়ার অন্তত ৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। টিউবওয়েলেও পানি ওঠে না, মেশিনেও পানি ওঠে না। খাল, নালায় কোথাও পানি নেই। খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।

দাকোপ উপজেলার চুনকুড়ি গ্রামের কৃষক জীবানন্দ মণ্ডল বলেন, এ মৌসুমে চার বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। খরচ হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ফলন মোটামুটি ভালো হলেও কয়েক দিনের দাবদাহের কারণে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। মেশিনে পানি উঠছে না। আশপাশের খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে, তরমুজের সাইজ ছোট হয়ে যাচ্ছে। দুই-এক দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে এবার লোকসানে পড়তে হবে।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহন  কুমার ঘোষ বলেন, সাধারণত তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির উপরে উঠলে ফসলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির উপরে উঠলে ধান চিটা হয়ে যায়। এ অবস্থায় খুলনা অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির উপরে ওঠানামা করছে- যা দুশ্চিন্তার বিষয়।

 

তিনি আরও বলেন, নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা জমিতে চাহিদা মতো সেচ দিতে পারছে না। এছাড়া লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণেও ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে-এই দাবদাহের সময়ে ফল-ফলাদির গাছে খুব ভোরে অথবা সন্ধ্যায় ৭ থেকে ১০ দিন পর পর সেচ দেওয়ার জন্য। এছাড়া কৃষি জমিতেও পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সেচের পানির তীব্র অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচের পানি থাকলে আমাদের এই দাবদাহ খুব একটা ক্ষতি করতে পারত না। খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ত মাটি ও পানি বেশি। আমাদের নদীর পানিতে লবণাক্ততা, খালের পানিতে লবণাক্ততা। আমাদের প্রয়োজনীয় জলাধার নেই। যেখানে আমরা ভূ-উপরিস্থ পানি (সারফেস ওয়াটার) ধরে রাখতে পারব। 

সে জন্য আমরা সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছি, মোট দেড় হাজার কিলোমিটারের ৬১৫টি খাল পুনঃখননের জন্য। ইতিমধ্যে এর কিছু কাজ বিএডিসির মাধ্যমে শুরুও হয়েছে। এছাড়া অকেজো ৬৪৯টি স্লুইস গেট মেরামতের মাধ্যমে চালু করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

Share This Article