ভ্যালেন্টাইনস ডে: রোমানদের আনন্দ উৎসব নাকি ধর্মযাজকের মৃত্যুর স্মরণ!

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:২৯, বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১ ফাল্গুন ১৪৩০

ভ্যালেন্টাইনস ডে কীভাবে এসেছিল তার অনেকগুলো ব্যাখ্যার মধ্যে একটি হল প্রাচীন উৎসব লুপারকালিয়া। রোমান এ উৎসব থেকে এই দিবস উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। এটি ছিল তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত মৌসুম শুরু হওয়ার সময়। এছাড়া এসময় প্রাচীন রোমান পুরুষ এবং মহিলারা পরস্পরের সাথে এক হওয়ার খুশিতে ওয়াইন খেয়ে এ উৎসব পালন করতো ।

বছর ঘুরে আবারও চলে এলো ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন্স ডে। এ দিনে সারাবিশ্বের মানুষ নানান ভাবে তার প্রিয় মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে থাকে। কেউ বা প্রিয়জনের সাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করে, কেউ বা চকলেট গিফট করে। কেউ বা আবার তার সঙ্গীর সাথে রাতে কমেডি সিনেমা দেখার মাধ্যমে দিনটি পালন করে।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিনটিকে বেশ ঘটা করে পালন করা হচ্ছে। তবে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এই দিবসটি এলো কীভাবে? এবং কেনই বা এত আয়োজন নিয়ে এ দিনটি পালন করা হয়?

দীর্ঘদিন ধরেই মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৮৫৩ সালে এই দিনটির উৎপত্তি সম্পর্কে প্রথম চিন্তাভাবনা করেছিল। কিন্তু ওইসময় এটিকে রহস্যময়, ঐতিহাসিক বা পুরাকীর্তি সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি, যা কখনই সমাধান করা যাবে না বলে অভিহিত করা হয়েছিল।

ভ্যালেন্টাইনস ডে কীভাবে এসেছিল তার অনেকগুলো ব্যাখ্যার মধ্যে একটি হল প্রাচীন উৎসব লুপারকালিয়া। রোমান এ উৎসব থেকে এই দিবস উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। এটি ছিল তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত মৌসুম শুরু হওয়ার সময়। এছাড়া এসময় প্রাচীন রোমান পুরুষ এবং মহিলারা পরস্পরের সাথে এক হওয়ার খুশিতে ওয়াইন খেয়ে এ উৎসব পালন করতো।

শতাব্দী ধরে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সপ্তাহে এ উৎসব পালন হয়ে এসেছে। সময়ের সাথে সাথে খ্রিষ্টধর্ম ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে লুপারকালিয়া উৎসব আমাদের বর্তমান ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে পরিণত হয়। এই রূপান্তরের জন্য মূলত পঞ্চম শতাব্দীতে পোপ জেলাসিয়াস প্রথমকে দায়ী করা হয়েছিল, যিনি পৌত্তলিক উৎসবগুলোকে খ্রিস্টানদের উৎসবে রূপান্তর করার চেষ্টা করেছিলেন।

যদিও লুপারকালিয়া উৎসবকে অনেকে আনন্দ এবং নগ্নতা দ্বারা চিহ্নিত করেছিলেন। সেখানে অনেকে মনে করেন, খ্রিষ্টান অভিযোজিত ভ্যালেন্টাইন্স ডে এক্ষেত্রে আরও বিনয়ী এবং রোমান্টিক সুর নিয়ে এসেছে।

ইয়েল ইতিহাসবিদ নোয়েল লেনস্কি ২০১১ সালে ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওকে বলেছিলেন, পঞ্চম শতাব্দীতে পোপ প্রথম গেলাসিয়াস খ্রিষ্টান ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা না করা পর্যন্ত এই উৎসবটি তার অশ্লীলতা এবং নগ্নতার জন্য পরিচিত ছিল।

ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে আরেকটি যে গল্প, সেটি অত্যাচারী রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এবং খ্রিষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দিয়ে।

সে সময় সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিবাহ নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ নিয়ে তার যুক্তি ছিল, বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিত পুরুষরা সেনা হিসেবে বেশি সক্ষম।

অন্যায় মনে করায় এর প্রতিবাদ জানান ভ্যালেন্টাইন। তিনি সকল নিয়ম ভেঙে গোপনে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমান সৈন্যদের বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশ অমান্য করেছিলেন এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

রোমান পুরুষরা তখন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর প্রতি সম্মান জানাতে যোগ্য যুবতীদের নাম টেনে আনার ঐতিহ্য শুরু করে। এই রীতি অব্যাহত ছিল এবং শেষ পর্যন্ত জার্মানি এবং ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৩ সালে মারা যাওয়া কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক জ্যাক বি ওরুচ, ভ্যালেন্টাইনস ডে এর উৎপত্তি সম্পর্কে একটি ভিন্ন তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিখ্যাত কবি জিওফ্রে চসার সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্পর্কে আমাদের আধুনিক ধারণা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৯৮১ সালের একটি অ্যাকাডেমিক নিবন্ধ, 'সেন্ট ভ্যালেন্টাইন, চসার এবং ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত' তে মি. ওরুচ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, চসারের ১৪ শতকের শেষের দিকে 'পার্লামেন্ট অফ ফাউলস' এবং 'দ্য কমপ্লেইন অফ মার্স' কবিতাগুলো লেখার আগে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সাথে রোমান্টিকতার যোগসূত্রের কোনো প্রমাণ বা নথি ছিল না।

মি. ওরুচ জানান, চসার হয়ত সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে রোম্যান্সের সাথে যুক্ত করেছিলেন। কারণ এটি সবদিক থেকে সুবিধাজনক ছিল। তার মতে, ১৪ শতকের ব্রিটিশরা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এ সময়কে বসন্ত শুরু হওয়ার সময় মনে করতো। তারা মনে করতো এ সময়ে বসন্তের আগমনে পাখিরাও মিলিত হওয়া শুরু করে, গাছে ফুল ফোটতে শুরু করে।

চসারের দৃষ্টিকোণ থেকে, এরূপ করার একটি অতিরিক্ত সুবিধা হলো সেই সময়ে ইউরোপীয়দের কাছে 'ভ্যালেন্টাইন' একটি সুন্দর নাম হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অন্যান্য সাধুদের নামে কাবিক্যতা কম ছিল, যেমন– সেন্ট স্কলাস্টিকা, সেন্ট অস্ট্রেবার্থা, সেন্ট ইউলালিয়া এবং সেন্ট ইওরমেনহিল্ড।

যাইহোক, ওরুচের গবেষণা ভ্যালেন্টাইনস ডে সম্পর্কিত রোমান্টিক রোমান গল্পগুলোর বিশ্বাসকে এখনও অতটা পরিবর্তন করতে পারেনি।

মানব যৌনতার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক নৃবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার বলেন, এর উৎপত্তি যেভাবেই হোক না কেন, ভ্যালেন্টাইনস ডে এখন আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।

তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, ভ্যালেন্টাইনস ডে অনেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ এটি আমাদের মস্তিষ্কের গভীর মানসিক আকাঙ্ক্ষাকে সক্রিয় করে। মানব যৌনতার বিবর্তন সম্পর্কে ফিশারের গবেষণা পরামর্শ দেয়, ভালোবাসার জন্য আকাঙ্ক্ষা আমাদের জীববিজ্ঞানের গভীরে প্রোথিত। সংযোগের এই সহজাত প্রয়োজনীয়তা ভ্যালেন্টাইনস ডে-এর ঐতিহাসিক উৎসের পূর্বাভাস দেয়, যেমন প্রাচীন উৎসব লুপারকালিয়া। এটি মানব অস্তিত্বে ভালোবাসা এবং সাহচর্যের স্থায়ী তাৎপর্যকে তুলে ধরে।

আমেরিকানরা ভালোবাসা দিবসে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে, যার বেশিরভাগই রোমান্টিক সঙ্গীদের পেছনে। ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বছর ভালোবাসা দিবসে আমেরিকানরা ২৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল, যা ২০২২ সালে ছিল ২৩.৯ বিলিয়ন ডলার।

যাদের রোমান্টিক সঙ্গী নেই, তাদের ডা. ফিশার পরামর্শ দেন যে, প্রত্যেকের জীবনেই কেউ না কেউ রয়েছে। প্রেমের জন্য সহজাত আকাঙ্ক্ষা একটি সুপ্ত বিড়ালের মতো যা যে কোনও মুহূর্তে জেগে ওঠতে পারে। মানুষকে নতুন সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতার জন্য উন্মুক্ত থাকতে উৎসাহিত থাকতেও উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। 

বিষয়ঃ দিবস

Share This Article