রাজধানীজুড়ে শীতের আমেজ
শীতের আমেজে পিঠা নিয়ে আসে নতুনত্ব। খেজুরের মিষ্টি রসের মিতালি আর পিঠা খাওয়ার দুম পড়ে যায়। রাজধানীজুড়ে সব শ্রেণির মানুষের শীতের পিঠপুলি আর গরম চায়ের ধোঁয়ায় জমে উঠে আড্ডা।
শীতের আগমনে গ্রামাঞ্চলে শিশির ভেজা সকালে খেজুরের মিষ্টি রসের মিতালি আর পিঠা খাওয়ার লেগেছে ধুম। ব্যতিক্রম নয় নগরজীবনও। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই রাজধানীজুড়ে সব শ্রেণির মানুষের শীতের পিঠপুলি আর গরম চায়ের ধোঁয়ায় জমে উঠেছে আড্ডা।
শীত এলেই জমে পিঠা বিক্রি। শীতের সন্ধ্যা বা সকালে গ্রাম হোক কিংবা শহর, গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠা ছাড়া শীত যেন ঠিক জমে ওঠে না। আর তাই শীত আসতে না আসতেই হরেক রকমের পিঠার স্বাদ নিতে মানুষ ছুটে আসছেন ফুটপাতে। এর মাধ্যমেই শুরু হয় পিঠা বিক্রেতাদের ব্যস্ততা। তবে গ্রামের মতো রাজধানীতে খেজুর রসের দেখা নেই। তবে শীতের বাহারি পিঠা দিয়ে নগরীর অলিগলি সেজে উঠেছে। এর মধ্যে ভাপা, চিতই ও ডিম চিতই পিঠাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিশেষ করে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে বন্ধুদের আড্ডায় অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে শীতের সুস্বাদু নানান পিঠা।
পিঠার টানে ফুটপাতে:
কাঁটাবন কনকর্ড টাওয়ারের সামনে কবি এস আই টুটুলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, শীত মৌসুম এলেই গ্রামের বাড়িতে নানান রকমের পিঠা তৈরি হতো। প্রস্তুতি শুরু হতো একদিন আগে থেকেই। যেদিন পিঠা বানানো হবে, সেদিন মনে হতো উৎসব। গুড়, চালের গুঁড়ো, সব ঠিকঠাক করে মা ও দাদি বসতেন পিঠা বানাতে। আর আমরা সবাই থাকতাম খাওয়ার অপেক্ষায়। গরম গরম পিঠা চুলা থেকে নামাতেই ফুঁ দিয়ে মুখে দিতাম। সে এক স্বর্গীয় স্বাদ! সে সময় এখন আর নেই। ফুটপাত থেকে কেনা পিঠা হাতে নিয়ে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শীতের পিঠা খাওয়া নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতিচারণ এভাবেই করেন তিনি।
শীত এলেই জমে পিঠা বিক্রি:
রাজধানীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র শিল্পকলা একাডেমি। ঠিক তার সামনে ফুটপাতে ভ্যানগাড়িতে করে বছর জুড়েই চিতই পিঠা বিক্রি হয়। আর শীত এলেই এর সঙ্গে ভাপা পিঠাও বিক্রি করেন হুজুর নাসির। তার বাড়ি নোয়াখালী অঞ্চলের চাঁদপুরে। ১৫ বছর যাবৎ তিনি এ ব্যবসা করছেন। তাকে সহযোগিতায় রয়েছেন তিন কর্মচারী।
একপাশে গ্যাসের চুলায় ছোট ছোট ১০ কড়াই, তৈরি হচ্ছে চিতই। অন্যপাশে তৈরি হচ্ছে ভাপা পিঠা। ব্যস্ততম এলাকা হওয়ার গরম পিঠাগুলো বেশিক্ষণ পড়ে থাকছে না পাত্রে। চুলা থেকে উঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রেতারা খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। সঙ্গে রয়েছে হরেক রকমের ভর্তা, ধনেপাতা, চিংড়ি, শুটকি, বাদাম, কালোজিরা, শর্ষে বাটার স্বাদ।
পিঠা বিক্রেতা নাসির জানান, মানুষের আনাগোনা বেশি হওয়ায় আল্লাহর রহমতে বিকিকিনিও বেশি। বিকেলের দিকে শুরু হয়ে অনেক রাত পর্যন্ত চলে পিঠা বিক্রি। শীত যত বেশি পড়বে, পিঠা বেচাকেনাও বাড়বে।
রাজধানীর এ্যালিফেন্ট রোড মাল্টিপ্লান মার্কেটের সামনে ভ্যান ভর্তি হরেক রকমের পিঠা সাজিয়ে বসেন মোহাম্মাদ মনসুর। ফুটপাতে বেশিরভাগ দোকানেই চিতই আর ভাপা পিঠা থাকলেও তিনি বিক্রি করেন মিষ্টি আর জাল পিঠা। আলাদা আলাদা পাত্রে সাজানো পিঠাগুলো ঢেকে রেখেছেন পলিথিন দিয়ে। পাটিসাপটা, বালুসা, নকশা, খাজা, শাপলা, মালপোয়া, পাকন, পুলি, পোয়া, জালপিঠাসহ মোট ১২ ধরনের পিঠা তিনি বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, ময়মনসিংহ থেকে তিনি ঢাকায় এসেছেন। সব জায়গাতে চিতই আর ভাপা। তিনি তাই এসব মিষ্টি পিঠার দিকে ঝুঁকেছেন। দৈনিক কত পিঠা বিক্রি করেন জানতে চাইলে বললেন, ঠিক নাই। কখনো ৪০০-৫০০ টাকার পিঠাও হয়। কেউ এক-দুইটা খায়, ভালো লাগলে কেউ বাড়িতেও নিয়ে যান।
ফুটপাতে রাশেদ হাওলাদার মতো অনেকেই এসেছেন পিঠা খেতে। কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন, কেউ বাসা-বাড়ির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন।
পারুল ও তার স্বামী লাভু এসেছেন পিঠা কিনতে। তিনি বলেন, ঘরে বানানোর ঝামালা এড়াতেই ফুটপাতে পিঠা খেতে আসা। এখন আর ঢাকা শহরে কেউ বাসাবাড়িতে পিঠা বানানোর আয়োজন করে না।
অধিকাংশই মৌসুমি পিঠা বিক্রেতা:
ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই এ পেশাকে বেছে নিয়েছেন খণ্ডকালীন হিসেবে। শীতের ৩-৪ মাস বাদে বাকি সময়টা তাদের বেছে নিতে হয় ভিন্ন নানান পেশা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চাঁদপুর শহর থেকে আসা ফারুক মিয়া বলেন, যে ভ্যানে এখন পিঠা বিক্রি করছি, এই ভ্যানেই গরমে শরবত বিক্রি করেছি। শীতে পিঠার চাহিদা ও বিক্রি বেশি, তাই এখন পিঠা বিক্রি করছি।
শাহবাগ এলাকার পিঠা বিক্রেতা শাজাহান মিয়া বলেন, শীতে পিঠার চাহিদা বেড়ে যায়। প্রতিবছরই শীতে পিঠা বিক্রি করি। এবারও করছি। ভাপা ও চিতই পিঠা বিক্রি করলেও আমি সারা বছর চা-সিগারেট বিক্রি করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক ছাত্রী রানী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনের সেই পুরনো আড্ডা এখনও হৃদয়ে নাড়া দেয়। বিশেষ করে শীতের সন্ধ্যার আমেজে পিঠা খাওয়া আড্ডার সেই সময়গুলোর। তাই সময় পেলেই এখনও চলে আসি।