কেন মার্কিন কূটনীতিকরা বারংবার বাংলাদেশে আসছেন
মজার বিষয় হচ্ছে, এই বঙ্গোপসাগরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হচ্ছে বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশও এই খেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ইতিমধ্যেই এই এলাকা কেন্দ্রিক কৌশল নিয়ে তৎপর হতে শুরু করেছে এবং বিনিয়োগও বাড়াচ্ছে।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছাড়াও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাব্যাক্তিদের এমন ঘনঘন সফর দেখে অবাক হচ্ছেন। তবে এর পেছনের কারণটি জানতে হলে আমাদেরকে ঘটনার একটু গভীরে যেতে হবে।
বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার একটি ছোট রাষ্ট্র হলেও বিগত কিছু বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ হয়ে উঠেছে । আর এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও সাম্প্রতিক নানান ঘটনা।
গত কয়েক বছর আগে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বের নজরে চলে আসে বাংলাদেশ। এই রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য একটি মানবিক-কূটনৈতিক অগ্নি পরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছিল।আর এই পরীক্ষায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় সারা বিশ্ব মিয়ানমারকে নিন্দা জানালেও বিশ্বের কোন দেশই এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই একজন বন্ধুর মতো বাংলাদেশের পাশে থেকেছে।
এছাড়া প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য জায়গা দিতে রাজি হয়েছেন এবং পরবর্তিতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।এমনকি অন্যান্য দেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্যও বাইডেন প্রশাসন চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সবগুলো বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।দেশটি এ পর্যন্ত এককভাবে ১.৯ বিলিয়ন ডলারের ত্রাণ সহযোগীতাও দিয়েছে রোহিঙ্গাদের।তবে এসবের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো প্যাসেফিক কৌশল' কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) নতুনভাবে সাজিয়েছে। তাদের লক্ষ্য এই এলাকায় অবাধ বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করা। অন্যদিকে চীন ইতিমধ্যেই এই এলাকায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে এবং নবাগত শক্তি হিসেবে ভারত এই এলাকার বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
বলা হচ্ছে আগামীতে বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠতে যাচ্ছে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল। এটি বিশ্বের বৃহৎ একটি কনজিউমার এরিয়া। এছাড়া ইন্দো প্যাসেফিক এরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। কারন এই বঙ্গোপসাগর দিয়েই বিশ্বের এক চতুর্থাংশ বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। তাই এই এলাকায় যার নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি থাকবে বৈশ্বিক বাণিজ্যর অনেককিছুই তার নিয়ন্ত্রনে থাকবে।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই বঙ্গোপসাগরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হচ্ছে বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশও এই খেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ইতিমধ্যেই এই এলাকা কেন্দ্রিক কৌশল নিয়ে তৎপর হতে শুরু করেছে এবং বিনিয়োগও বাড়াচ্ছে।
বলা যায় চীন-ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এ এলাকায় তাদের প্রতিযোগীতা শুরু করেছে। তিনটি দেশই অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের প্রভাব বলয়ে আনার চেষ্টা করছে। প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকতে চীনের পাশপাশি যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশে তাদের আনাগোনা বৃদ্ধি করেছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। এখন পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাওয়ার প্ল্যান্ট, কয়লা খনি এবং সার কারখানায় প্রায় ৪.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।উল্লেখিত প্রত্যেকটি দেশই বাংলাদেশকে তাদের ব্লকে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া বাংলাদেশ গত এক দশকে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি লোভনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল ভোক্তা বাজার। অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেল এবং পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশকে এদেশে বিনিয়োগ করার জন্য যথেষ্ট প্রলুব্ধ করেছে।
তাই গত বছরের জুলাই মাসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাদের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য নতুন করে পরামর্শও দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে আরও সরকারী সফর সহ পারস্পরিক সামরিক,অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগীতা বিনিময়ের মত উদ্যোগও দেখা যেতে পারে, যা দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।