এপ্রিলে সব বন্দরে ‘গ্রিন চ্যানেল’ চালু

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সন্ধ্যা ০৬:০৯, বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২২, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৯

এনবিআরের কাস্টমস নিরীক্ষা মূল্যায়ন কমিশনারেটের কমিশনার এনামূল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাকে তাকে গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের সুবিধা দেয়া যায় না। অতীত রেকর্ড স্বচ্ছ, কোনো ধরনের মামলা-মোকদ্দমা নেই, নিয়মিত কর দিয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে, তাদের কাস্টমসে কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে না। ফলে তাদের পণ্য-আনা নেয়া সহজ হবে এবং ব্যবসার খরচ কমবে।’

আগামী বছরের এপ্রিলে সব বন্দরে ‘গ্রিন চ্যানেল’ চালু করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ব্যয় ও সময় কমবে।

এনবিআর সূত্র বলেছে, সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে এবং অতীত রেকর্ড ভালো এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এ ‘গ্রিন চ্যানেল’ সুবিধা পাবে। আর যোগ্য প্রতিষ্ঠান নিবার্চনের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। তার আলোকেই সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হবে।

গ্রিন চ্যানেল ব্যবহার করলে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের কায়িক কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে না। বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পর বিল অফ এন্ট্রি দাখিল করলেই প্রযোজ্য শুল্ক-কর পরিশোধ করে দ্রুত পণ্য খালাস করা যাবে। একইভাবে রপ্তানিকারকরাও তাদের পণ্য দ্রুত শিপমেন্ট করতে পারবেন।

এনবিআর কর্মকর্তা বলেন, যেসব দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের সুবিধা পাবে, তাদের মালামাল খালাস ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হবে। সে সুবাদে বন্দরে মালামাল আটকে থাকার জন্য যে ক্ষতি হয়, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। পণ্য লোড-আনলোড বা ওঠানামার খরচ লাগবে না। লিড টাইম (ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছাতে) কমবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হওয়ার পাশাপাশি খরচ কমবে।

তারা আরও বলেন, কাস্টমসকে আধুনিকায়ন করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। তারই অংশ হিসেবে গ্রিন চ্যানলে চালু করা হচ্ছে। অথরাইজড ইকনোমিক অপারেটর বা এইওর আওতায় এটি চালু করা হচ্ছে।

কাস্টমসকে আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে অথরাইজড ইকনোমিক অপারেটর চালু করা হয় ২০১৯ সালে। এটি চালুর উদ্দেশ্য হলো আমদানি পণ্য দ্রুত খালাস ও রপ্তানি পণ্য দ্রুত শিপমেন্ট করা। যেসব প্রতিষ্ঠান যোগ্য বিবেচিত হবে, শুধু তারাই গ্রিন চ্যানেল ব্যবহার করতে পারবে।

বিশ্ব শুল্ক সংস্থা (ডব্লিউওসি) ২০০৫ সালে পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য এইও কর্মসূচি চালু করে। কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে বিদ্যমান শুল্ক আইন সংশোধন করে।

২০১৮ সালে এনবিআর এইও সুবিধা পাওয়ার মানদণ্ড উল্লেখ করে একটি আদেশ জারি করে। পরের বছর ওষুধ খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এ সুবিধা দেয়া হয়। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও গ্রিন চ্যানেলের সুবিধা পায়নি।

সূত্র বলেছে, এ পর্যন্ত ৬১টি প্রতিষ্ঠান অথরাইজড ইকনোমিক অপারেটর (গ্রিন চ্যানেল) সুবিধা পাওয়ার জন্য এনবিআরের কাছে আবেদন করেছে। এর মধ্যে ২৪টিকে যোগ্য বলে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

অথরাইজড ইকনোমিক অপারেটর প্রক্রিয়ার সঙ্গে এনবিআরের কাস্টমস নিরীক্ষা মূল্যায়ন কমিশনারেট যুক্ত।

কমিশনার এনামূল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাকে তাকে গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের সুবিধা দেয়া যায় না। অতীত রেকর্ড স্বচ্ছ, কোনো ধরনের মামলা-মোকদ্দমা নেই, নিয়মিত কর দিয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

‘যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে, তাদের কাস্টমসে কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে না। ফলে তাদের পণ্য আনা-নেয়া সহজ হবে এবং ব্যবসার খরচ কমবে।’

এ পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অথরাইজড ইকনোমিক অপারেটরের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো বেক্সিমকো, স্কয়ার ও ইনসেপটা। যদিও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, পণ্য খালাসে কোনো হেরফের হয়নি এখনও।

এনবিআর বলেছে, এইও চালুর জন্য কিছু প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আশা করা যাচ্ছে, এপ্রিলে এটি চালু করা যাবে।

কাস্টমস সূত্র বলেছে, আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানকে গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের অনুমোদন দেবে এনবিআর। পাইপলাইনে আছে আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান।

কাস্টমস নিরীক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, যারা গ্রিন চ্যানেল ব্যবহারের অনুমতি পাবে, তাদের আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত তথ্য দেখভাল করার জন্য বিশেষ সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হচ্ছে। এই সফটওয়্যার এনবিআরের এসআই কুডা সিস্টেমের সঙ্গে ডিজিটাল সংযোগ বা কানেক্ট করা হবে। এটা করা হলে যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয়ভাবে এনবিআরে বসে‌ই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

কমিশনার এনামূল হক বলেন, ‘ডিজিটাল সংযোগ করা হলে বন্দরে পণ্য খালাসের সময় ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশনের দরকার হবে না। অফিসে বসেই মনিটর করা যাবে।’

কয়েকটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে এইও সুবিধা দেয়া হয়। এর মধ্যে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর আইনের আওতায় সন্তোষজনক কমপ্লায়েন্স রেকর্ড থাকতে হবে। আবেদনকারীকে আগের তিন বছর অপরাধমুক্ত থাকতে হবে। কোনো রাজস্ব বকেয়া থাকা যাবে না; যেকোনো মামলায় জরিমানার পরিমাণ মোট পণ্য বা সেবামূল্যের ১ শতাংশের বেশি হওয়া যাবে না।

এ ছাড়া আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন অন্তত ৫ কোটি টাকা হতে হবে। আর বার্ষিক আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ন্যূনতম ৫ কোটি টাকা হতে হবে।

এ ব্যবস্থা পরীক্ষামূলক চালু হওয়ার সময় এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এক মাসের মধ্যে টেক্সটাইল, ওষুধ ও চামড়া খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আরও ১০টি প্রতিষ্ঠানকে এইও সনদ দেয়ার জন্য বাছাই করা হবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এইওর আওতায় আনা হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এনবিআর প্রক্রিয়াটি আরও উন্নত ও জনপ্রিয় করতে না পারায় অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর উদ্যোগে ভাটা পড়ে। তা ছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তাদের মনোভাব পরির্বতন করা দরকার।

এদিকে সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে এখনও আগের মতোই তিন থেকে চার দিন সময় লাগছে। এ জন্য কাস্টমসের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করেন তারা।

এ বিষয়ে এনবিআরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, সনদপ্রাপ্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলেও তারা তা করছে না। সে কারণে এইও সুবিধা পাচ্ছে না কোম্পানিগুলো।

ডব্লিউসিওর তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এইও সনদ পাওয়া প্রতিষ্ঠান ১১ হাজার ২০টি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ১৭ হাজার ৮৯৫টি, চীনে ৩ হাজার ২০৩টি, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮৪৫টি এবং জাপানে ৭০৬টি।

বিশ্বব্যাংকের সবশেষ ২০২০ সালের ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদনে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম। কাস্টমস ও বন্দরে দক্ষতার অভাব বাংলাদেশের এই পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।

এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই) অনুযায়ী চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়াসহ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এই সূচকেও বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করেছিল।

এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আরও বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে এইও সনদ দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এ উদ্যোগ বন্দরে জট কমানোর পাশাপাশি ব্যবসায় সময় ও খরচ কমাতে সাহায্য করবে।’

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article