ড. শামসুল আলমের নিবন্ধ

উন্নয়নের লাইফ লাইন মেগা প্রকল্প

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সন্ধ্যা ০৭:১৭, বুধবার, ১৯ জুলাই, ২০২৩, ৪ শ্রাবণ ১৪৩০

একটি দেশের উন্নয়নে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শন মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। ফলে দ্রুত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অবকাঠামোসহ আর্থসামাজিক অনেক ক্ষেত্রেই এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এগুলো সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতার ফলে। প্রায় ১৫ বছর ধরে ধারাবাহিকতার সুফল পাচ্ছে জনগণ। 

মেগা প্রকল্পগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের সাহসী ও দূরদর্শী পদক্ষেপের ফসল। এর সুফল এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে দেশবাসী। এগুলো উন্নয়নের লাইফ লাইন। কেননা একটি দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন সে দেশের সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আগে এ দেশে মেগা প্রকল্পের ধারণাই ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শুধু প্রকল্প হাতে নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি, নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সেগুলো নিয়ে গেছে বাস্তবায়ন পর্যায়ে। প্রায় দেড় দশক ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। এ দীর্ঘ সময় একই ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন কাজ করেছে। এ দেশের উন্নয়নে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শন মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। ফলে দ্রুত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অবকাঠামোসহ আর্থসামাজিক অনেক ক্ষেত্রেই এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এগুলো সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতার ফলে। প্রায় ১৫ বছর ধরে ধারাবাহিকতার সুফল পাচ্ছে জনগণ। দেশে এখন প্রায় শতভাগ বিদ্যুৎ পাচ্ছে মানুষ। যেটি আগে কল্পনাও করা যেত না।

এর মধ্যে অনেক ঝড়ঝাপ্টা এসেছে। ২০২০-২১, ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে করোনা মহামারির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে হয়েছে। শুধু এ দেশেই নয়, পুরো বিশ্ব এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে আর্থসামাজিক খাতের যে গতিশীলতা ছিল, সেটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে; তারপরও অর্থনীতি ইতিবাচকভাবে এগিয়েছে। বাংলাদেশ থেমে যায়নি এর মূল কারণ অবকাঠামোগত শক্ত ভিত্তি। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও সেই অনুযায়ী দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ফলে আমরা ভালোভাবেই টিকে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দারিদ্র্য নিরসন, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উল্লেখযোগ্য অর্জনসহ নানা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখায় স্বীকৃতি পেয়েছে।

সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় অনেক অর্জন আমাদের আছে। যেমন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর অন্যতম। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ। এ অর্জনের পেছনে মূল ভিত্তি ছিল মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও সামাজিক সূচকে অগ্রগতি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোসহ নানা সামাজিক সূচকের ক্রমাগত উন্নতি। সবই অর্জিত হয়েছে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যের কারণেই। সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অর্জনে প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছি আমরা।

আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই দেশ পরিচালিত হয়েছে জাতীয় পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, শতবছরের বদ্বীপ পরিকল্পনাসহ নানা ক্ষেত্রে পরিকল্পনা তৈরি ও সেগুলো বাস্তবায়নে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এ পরিকল্পিত অর্থনীতির ফলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কেননা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে না। এটি একটি দেশের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি খেয়াল করে দেখবেন আপনার পরিবারের ক্ষেত্রেও সঠিক কৌশল।

তর্কের খাতিরে যদি ভাবা যায় যে, রাজনৈতিক হাতবদল ঘটলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের পরিবর্তন ঘটতে পারে। যে কোনো সরকারের নিজস্ব দর্শন থাকে। এখানে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল অন্য কোনো দলের সরকার (যদি) দায়িত্বে এলে তাদের দর্শন কী হবে। তারা আমাদের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করবে কি না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিএনপি ২০০১ সালে সরকার গঠনের পর কোনো পরিকল্পনাই করেনি। তার আগে আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পনামাফিকই এগিয়েছিল। জনকল্যাণ, কল্যাণরাষ্ট্র ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনার মূল উপজীব্য বিষয়। কিন্তু বিএনপি সরকারে এসে কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা না করে বরং বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে (পিআরএসপি) দেশ চালিয়েছে। ২০২৩ সালের আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি ভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসেও, তাহলে উন্নয়ন সংজ্ঞা বদলে যেতে পারে। এখন এবং তখনকার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ঘটবে। দেশের চলমান উন্নয়ন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুফল, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা এবং লক্ষ্যের ধারাবাহিকতায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে। এ ক্ষেত্রে ছেদ পড়লে উন্নয়নযাত্রা খানিকটা হলেও হোঁচট খাবে। বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের মতো ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার বিস্তৃতি ঘটতে পারে। এ ধরনের পরিবর্তন প্রথম দিকে একটা ঝাঁকুনি দেবে। সেটি কাটিয়ে উঠে কতটা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। ২০৪১ সালের মধ্যে কোন বছরে কত প্রবৃদ্ধি হবে, মূল্যস্ফীতি কতটুকু নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এসবের কাঠামো ও পরিকল্পনায় একটা সংখ্যাতাত্ত্বিক অর্জনের উল্লেখ রয়েছে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনায়। সেগুলো অর্জনে কাজ করছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে বদ্বীপ পরিকল্পনা রাখবে কি না, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা রাখবে কি না, এগুলো প্রশ্ন রয়েছে। কেননা অতীতে তারা (বিএনপি) পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়েছিল। তাই এ ক্ষেত্রে একটা অনিশ্চিত যাত্রাপথে পা রাখবে দেশ। তবে এটা বলা যায়, অন্য কোনো সরকার এলেও চলমান মেগা প্রকল্প বন্ধ করার চিন্তা করতে পারবে না। কেননা বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজই শেষের পথে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। প্রকল্পগুলোর পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে। জনগণ সুফল পেতে শুরু করেছে। এগুলোতে হাত দিতে গেলে অবশ্যই জনরোষ তৈরি হবে। যেমন মেট্রোরেল প্রকল্প তো বন্ধ করতে পারবে না। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প। এ বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনেকদূর এগিয়েছে। কর্ণফুলী টানেল চালু হচ্ছে। কাজেই এগুলো বাদ দিতে পারবে না। কিন্তু যেসব মেগা প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং চলমান আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই অগ্রগতি ও উন্নয়ন চাইলে আওয়ামী লীগ সরকারেরই ধারাবাহিকতা প্রয়োজন অপরিহার্য।

চলতি অর্থবছর মেগা প্রকল্পে সর্বোচ্চ গুরুত্ব : এ সরকার সবসময়ই অর্থ বরাদ্দে মেগা প্রকল্পগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বড় উন্নয়ন প্রকল্পে। এরকম ১৪টি মেগা প্রকল্প ও কর্মসূচি মিলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল ৫৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় এ অর্থ বরাদ্দ ধরা হয়েছে। তবে সব প্রকল্পেই বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ বিবেচনা করা হয়। অহেতুক বরাদ্দ দিয়ে অর্থের অপচয় এড়ানো হয়েছে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে দেওয়া বরাদ্দের তুলনায় আগামী অর্থবছর বরাদ্দ বৃদ্ধি পাওয়া প্রকল্পগুলো হলো মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, মেট্রোরেল লাইন-৬, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে এবং বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প। আরও আছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (প্রথম পর্যায়), চতুর্থ স্বাস্থ্য-জনসংখ্যা, পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ এবং চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি। এদিকে বরাদ্দ কিছুটা কমেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (পিপিপি) নির্মাণ এবং কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং পায়রা বন্দরের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রকল্পেও বরাদ্দ কমেছে। মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে (আরএডিপি) বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। গত বছর জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ক্রয়পুঞ্জিত (শুরু থেকে খরচ) ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৮১১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ২৫৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পে আরএডিপিতে ছিল ৩ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। গত বছর জুন মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ১৭ হাজার ১২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আগামী এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৩০০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ হয়েছে ৫ হাজার ৮৭০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণে গত অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৬৯৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৪২১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ১৯৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে চলতি বরাদ্দ ছিল ১৮৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। গত বছর জুন পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ৩০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ পেয়েছে ৪ হাজার ৫৪৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (প্রথম পর্যায়) প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৪৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৪০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ হাজার ৪৯৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। চতুর্থ স্বাস্থ্য-জনসংখ্যা, পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৮৯৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ১১ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ৩৬৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ আছে ৮ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার ১৩৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। গত বছর জুন পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৫৫ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর বরাদ্দ কমিয়ে ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭০৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (পিপিপি) প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২১৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ১১৮ কোটি টাকা। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ৬ হাজার ৮০৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এডিপিতে বরাদ্দ পেয়েছে ৭৩৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৯০৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পায়রা বন্দর উন্নয়ন আনুষঙ্গিক কার্যক্রম প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২৮৬ কোটি টাকা। গত বছর জুন পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৬০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা।

ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা : ফাস্টট্র্যাকের ধারণা এসেছে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকেই। সর্বোচ্চ এবং বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া প্রকল্পগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে এ ফাস্টট্র্যাক গঠিত হয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসব নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। শুরু থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা আট প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৪২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। প্রকল্পগুলোর গড় ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬ হাজার ২৬৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল (আংশিক) উদ্বোধন হলেও প্রকল্প শেষ হতে এখনো বেশ কিছুটা সময় বাকি। গত বছর ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়নি। গত মে পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৭৬৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। পুরো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ গত বছর ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত সময়ে জনগণের চলাচলের জন্য খুলে গেছে এ অংশটি। কিন্তু পুরো প্রকল্প শেষ হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, চলতি বছর অক্টোবর নাগাদ মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশ খুলে দেওয়া হতে পারে। শুরু থেকে মে পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৮৮৪ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া ভৌত অগ্রগতি ৭৭ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশোধিত ব্যয়সহ মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় বাড়ার সঙ্গে মেয়াদ বেড়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এটির মূল ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বাড়তি অংশ যোগ হওয়ায় এ ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। শুরু থেকে মে পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৪৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫৩ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৫৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কভিড মহামারিতে সঞ্চালন লাইনের কাজ দেরি হওয়ায় কেন্দ্রটির উৎপাদন পিছিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ রূপপুর প্রকল্পটি উৎপাদনে আসতে পারে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে গত মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৫১২ কোটি ৮ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ ছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭৭ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে মোট ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম (১২টি প্রকল্পযুক্ত) প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। গত মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৬৬১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ৬২ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ৩০ শতাংশে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। গত মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯২ দশমিক ৭২ শতাংশ। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৬২৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮২ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৯ দশমিক ৮৪ শতাংশে।

দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৪২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ ছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ। এসব প্রকল্প যখন বাস্তবায়িত হবে তখন দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে আলো ছড়াবে। ঝলমলে হয়ে উঠবে বাংলার মুখ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আশা করব হট্টগোলের কোনো অপরাজনীতির কবলে পথ হারাবে না বাংলাদেশ।

লেখক : সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

Share This Article