গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে অনাস্থা তৈরিতে দায়ী যে দুই সংবাদ মোড়ল

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:২০, রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩, ১৯ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করলে ১/১১- এর কালপর্বটিকে আমরা কোনভাগে ফেলবো তা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়তে হয় আমাদের। কারণ, এই পর্বটিতেই কয়েকজন চিহ্নিত অরাজনৈতিক ব্যক্তি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে পাহারাদার হিসেবে রেখে দেশের বড় ও প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দকে বন্দি করার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়ে দেশের শাসনভার দখল করে রাখেন প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে। বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের ইতিহাস রয়েছে এবং তার স্বরূপ আমরা জানি। কিন্তু এই সময় এসে সেনাবাহিনী অস্ত্র হাতে নেপথ্যে থাকলেও ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আমরা যাদের সামনের সারিতে দণ্ডায়মান এবং মঞ্চে উপবিষ্ট হিসেবে দেখতে পেলাম তারা এতদিন নিজেদের রাজনীতি থেকে দূরে, রাজনীতির সমালোচনাকারী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কখনও “দুই বেগম”, কখনও স্বৈরাচারী, কখনও ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে নিজেদের এনজিও, ঋণ-ব্যবসা, কনসালটেন্সি, বিদেশি কোম্পানির হয়ে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার আইনজীবী এবং সর্বোপরি দেশের গণমাধ্যম তথা মিডিয়ার মোড়ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন।

সংবাদপত্রের মূল কাজ কী? সংবাদমাধ্যমের ছাত্র হিসেবে আমি যা জানি তা হলো, সমাজের দৃশ্য ও অদৃশ্য ঘটনাপ্রবাহের খবর নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। একই সঙ্গে রাজনীতি এবং অর্থনীতির মতো জটিল ও তাত্ত্বিক বিষয়কে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে তাদের সামনে পেশ করা এবং বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থ ও সম্পর্ক বিষয়ে পাঠককে সচেতন করা। এর ফলে সংবাদপত্র ও পাঠকের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া ঘটে তা দিয়ে মানুষ তার অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত হয়, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে জানতে পারে, তাদের নিজস্ব বোধ থেকে ঘটনা সম্পর্কে ধারণা ও মতামত তৈরি করতে পারে, নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে, প্রয়োজনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে; এই প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতি ভেদে কখনও হতে পারে সমর্থন, প্রতিবাদ কিংবা আন্দোলন-সংগ্রাম, এমনকি ভোট প্রদানের ক্ষেত্রেও নাগরিকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংবাদমাধ্যম কাজ করতে পারে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে যেকোনও সংবাদপত্র এসব ভূমিকা পালনে গণমানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

গণতান্ত্রিক বিশ্বে সংবাদপত্র প্রায়শই সমাজে বিদ্যমান অন্যায়, অসংগতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বৈরাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ কিংবা মতামত প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় অস্থিরতায় ভোগে। একে ইতিবাচকভাবেই দেখা হয়ে থাকে সর্বত্র। কোনও কোনও সংবাদপত্র নিজেদের ক্ষমতাকে ঐশ্বরিক পর্যায়ে উন্নীত করে ফেলে সময় ভেদে এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টায় লিপ্ত হয়। গোলটা বাধে তখনই যখন এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা কিংবা মাধ্যমটি তার জন্য বেঁধে দেওয়া লক্ষণরেখা বা লালরেখা অতিক্রম করে সীমার বাইরে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এই অনধিকার চর্চায় পত্রিকা বা মাধ্যমটি তখন নিজেদের এতটাই শক্তিশালী ভাবতে শুরু করে যে তার পেছনে তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে জুটে যায় এবং তারা এতে আরও বলীয়ান হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিজেরাই একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে।

বাংলাদেশের প্রধান দুটি দৈনিক সংবাদপত্র প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার। তারা বিখ্যাত ও পাঠকপ্রিয় তাদের বিভিন্ন অনুসন্ধানী বা বিশ্লেষণী সংবাদের পাশাপাশি সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত ও বিজ্ঞজনদের মতামত প্রকাশ এবং নিজেদের সম্পাদকীয় মতামত প্রকাশের জন্য। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, দৈনিক প্রথম আলো হচ্ছে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত আজকের কাগজের উত্তরসূরি। দ্য ডেইলি স্টারও আজকের কাগজের সমসাময়িক পত্রিকা। এ দুটি কাগজের, বিশেষ করে প্রথম আলোর সঙ্গে আমার নৈকট্যের কারণ অনেকটাই এ জন্যে এবং ডেইলি স্টারের ক্ষেত্রেও আমার আগ্রহ সমানভাবে কাজ করে।

এই শক্তিমান দুটি সংবাদপত্রের মালিক দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। হয়তো এই শক্তিবলেই কাগজ দুটির সম্পাদকদ্বয় মনে করলেন তারা আসলে এতটাই ক্ষমতাবান যে তাদের ক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া যায়। আমরা দেখতে পাই যে উদ্ভূত এই চিন্তা থেকেই রাষ্ট্রের এক গভীর রাজনৈতিক সংকটকালে তারা বিদেশি প্রেসক্রিপশন নিয়ে (কিংবা এমনও হতে পারে যে প্রেসক্রিপশনটি তাদের, বিদেশিরা কেবল সেটা গিলেছিল) রাজনীতির মাঠে নেমে পড়লেন। কৌশল ছিল বহুমুখী, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই এবং এই কৌশলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীজনেরও কমতি ছিল না। দুঃখজনক সত্য হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০০৬ থেকে ২০০৮ কালপর্বে যা কিছু ঘটেছে আজ এই মুহূর্তে আমরা তার পরিণতিকালে অবস্থান করছি। আরও কতদিন এই পরিণতি আমাদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে থাকবে সে নির্ণয় আমাদের জানা নেই। আমরা সবাই অবগত, আলোচ্য এই সম্পাদকদ্বয়ের রয়েছে একটি দীর্ঘ বাম রাজনীতির ইতিহাস।

বিশেষ করে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একতা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কমিউনিজমের কট্টরাবস্থা থেকে গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোইকা পেরিয়ে কোকাকোলা-অর্থনীতির সব পথেই মতিউর রহমান বিচরণ করেছেন এবং বাংলাদেশের শীর্ষ ধনী ব্যবসায়ীদের নৈকট্য অর্জনে তিনি যথেষ্টই পরিশ্রম করেছেন এবং তিনি তাতে সফলও হয়েছেন। অপরদিকে অখণ্ড পাকিস্তানে একদিনের প্রধানমন্ত্রী এবং দীর্ঘদিনের মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদের সন্তান মাহফুজ আনাম বাম রাজনীতি দিয়ে শুরু করলেও তিনি আসলে রাজনীতিতে হাত পাকিয়েছেন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার চাকরি থেকে। এর মাধ্যমেই তার একটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে, পরবর্তীতে যা তিনি দেশের ভেতর কাজে লাগান বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একজন যদি হন দেশীয় রাজনীতির ‘চাণক্য’, তাহলে আরেকজন নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘কিসিঞ্জার’।

এই ব্যক্তিদ্বয়ের এটুকু ইতিহাস জানা পাঠকের জন্য একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তির পরিচয় জানা না থাকলে ব্যক্তির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণাও অস্পষ্ট থাকার আশঙ্কা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে এটুকুও জানা জরুরি যে এই ভয়ংকর নেতিবাচক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। দেশের একমাত্র নোবেল বিজেতা হিসেবে যখন তার মানুষের দেওয়া সম্মানকে কাজে লাগিয়ে জাতিকে ভবিষ্যতের পথ দেখানোর কথা, তখন তিনি নেমেছিলেন অপরাজনীতিতে, স্বৈরশাসকগণ যেমন এ দেশে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন ক্ষমতায় থেকে, রাষ্ট্রের অর্থায়নে, অন্য দল থেকে নেতা ভাগিয়ে এনে। ঠিক এই পদ্ধতিতে ড. ইউনূস, মতিউর রহমান ও মাহ্ফুজ আনামরা লেগে পড়েছিলেন নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরিতে। এই অক্ষশক্তির সঙ্গে মেধা আর গবেষণার বড়াই নিয়ে যুক্ত হয় পশ্চিমা অর্থায়নে বাংলাদেশকে কাজে-অকাজে ছবক দেওয়া গবেষণা-প্রতিষ্ঠান, তথাকথিত থিংক ট্যাংক, সিপিডি বা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, লোকে অবশ্য তখন হাস্যরস করে বলতে শুরু করেছিল ‘সেন্টার ফর প্রথম আলো অ্যান্ড ডেইলি স্টার’। এখানে এ কথাটিও জানিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি, মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা নোয়াব-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান বেশ অনেক দিন থেকেই পরিচালনা করে আসছেন, যেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা তো দূরের কথা, প্রতিষ্ঠানটির রীতিনীতি সবই অস্বচ্ছ এবং জবাবদিহিহীন। তাদের কর্মকাণ্ডে এটাই মনে হয় যে প্রতিষ্ঠানটি আসলে কোনও আইন মান্য করা ট্রেডবডি নয়, বরং একটি ‘এলিট অ্যান্ড এক্সক্লুসিভ ক্লাব’।

অপরদিকে যে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তারা ‘নাগরিক শক্তি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছিলেন, তার মূল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন ড. ইউনূসের আপন ভাই উন্নয়নকর্মী মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, অন্য কেউ নন। এক যাত্রায় দুই ফল কেন হবে গোড়াতেই সে প্রশ্ন মানুষের মনে উঠেছিল, অন্তত গণমাধ্যমকর্মীদের মনে তো উঠেই ছিল, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এসব কথা এখানে এ কারণেই উল্লেখ করা, সামান্য একটি ট্রেডবডিতে যারা নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না তারাই কিনা দেশের প্রচলিত রাজনীতিকে নোংরা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক আখ্যা দিয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল খুলতে বসেছিলেন? যদি তারা সফল হতেন তাহলে কী হতো? আর তারা সফল না হওয়ায় কী ক্ষতি হয়েছে দেশের গণমাধ্যম, রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, সে বিষয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

আমরা জানি, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বিদেশি রাজনীতির যে ভয়ংকর ও ক্ষতিকারক চর্চা, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে উপরোক্ত অ-রাজনৈতিক শ্রেণির হাত ধরেই চলে আসছিল। বাংলাদেশে একটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেওয়ার এই বিদেশি চক্রটি মূলত পশ্চিমা দেশসমূহ থেকে আসা। পূর্বের দেশসমূহ, বিশেষ করে ভারত ও চীন এই পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী চক্রের বাইরে থাকলেও ১/১১-এর পরে তারাও বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে ছক কষে, সে হিসাব এখানে তেমন জরুরি নয়, কিন্তু ১/১১-পরবর্তী পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা থাকার জন্য বিষয়টি এখানে উল্লেখ করে রাখা হলো।

এই পশ্চিমা দেশগুলোই নিজেদের প্রয়োজনে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে কতিপয় ব্যক্তিকে পছন্দ করে তাদের ‘ইমেজ গঠন’ পূর্বক আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বিখ্যাত করে তুলতে বিভিন্ন পুরস্কার দেওয়া এবং তাদের চাপ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গ হিসেবে গড়ে তোলেন। আমরা দেখতে পেলাম যে ১/১১-এর সরকার হিসেবে যারা সামনে কিংবা নেপথ্যে থাকলেন তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে এমনতর আন্তর্জাতিক পরিচয়। যাদের আন্তর্জাতিক পরিচয় ছিল না তাদের এই অদ্ভুত সরকার নানাবিধ সহযোগীর পদ দিয়ে পাশে রেখে দেশের ভেতর ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছে। এবং এই যে সেনাবাহিনীকে পেছনে দাঁড় করিয়ে ক্ষমতা দখল, দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দিয়ে জোরপূর্বক শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগ দাঁড় করিয়ে তা কখনও ভয়েস রেকর্ড করে, কখনও ভিডিও করে গণমাধ্যমের হাতে তুলে দিয়ে তার প্রকাশ নিশ্চিত করা- এই পুরো প্রক্রিয়াটির পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রচারের মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন সবকিছুই হয়েছে এই মিডিয়া-মোড়লদের কিংবা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে এই মোড়লদ্বয়ের অংশগ্রহণ ও প্রশ্রয়ে।

প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তাদের স্বার্থ এখানে কী ছিল? স্নায়ুযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মিডিয়ার শনৈ শনৈ উন্নতিতে গোটা বিশ্বেই মিডিয়া এমন অভূতপূর্ব রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে যে কখনও কখনও, কোনও কোনও দেশে মিডিয়া নিজেদের আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি ভাবতে শুরু করে। আগেই আমরা ধারণা পেয়েছি যে বাংলাদেশেও সামরিক শাসন পরবর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুটি প্রধান দলের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ভেতর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের ক্ষমতাকে মনে করে আকাশচুম্বী এবং সব রকম জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। তারা মূলত পাঠকপ্রিয় এবং সরকারবিরোধী জনতুষ্টিমূলক সংবাদ প্রচারে নিজেদের ইমেজকে দাঁড় করায় এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে দেশের ভেতরকার এনজিও, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, সাবেক বাম কিন্তু পরবর্তীতে চরম ডানে চলে যাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিদেশি তেল-গ্যাস কিংবা মাল্টিন্যাশনালগুলোর স্বার্থ রক্ষাকারী আইনজীবী, যারা এভাবেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং একটু আগে বর্ণিত বিদেশিদের হাতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠা ব্যক্তিত্ববর্গ।

সমাজের এই স্বঘোষিত উঁচুতর ব্যক্তিবর্গ মিলে নিজেরাই নিজেদের একটি পরিচয়ও ঠিক করেন, তারা নিজেদের প্রচার করে ‘সুশীল সমাজ’ হিসেবে। আর এই সমাজের মুখপাত্র হিসেবে দেশের চিহ্নিত দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করা থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা সবই হয় আসলে বলতে গেলে পুরোপুরি বিদেশি প্রেসক্রিপশনে এবং বিদেশিদের দেওয়া ক্ষমতাবলে। এই দুটি সংবাদপত্রের (মোটামুটি একই মালিকানাধীন করপোরেট হাউজের) সম্পাদকদ্বয় নিজেদের দেশের প্রচলিত আইন-কানুন এবং রীতিনীতির ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে সক্ষম হন মূলত এই পুরো অক্ষশক্তির ঐক্য এবং একে অন্যের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে এই প্রক্রিয়ায় দেশের স্বার্থ সর্বোতভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।

স্বৈরশাসন-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি তার সব সীমাবদ্ধতা নিয়ে নিজেদের মতো করেই এগোচ্ছিল। এতে সহিংসতা ছিল, এতে দুর্নীতি ছিল এবং এর ভেতর পরিবারতন্ত্রের বীজ ছিল কিন্তু উপমহাদেশের রাজনৈতিক ধারায় সাধারণ জনগণ এ বিষয়ে কখনও উচ্চকিত ছিল না। তারা এই অবস্থার সঙ্গে সহাবস্থান করে এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছিল নিজেদের মতো করে, উপমহাদেশের অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিন্তু ১/১১-এর আগে ও পরে বাংলাদেশের রাজনীতিকে জনগণের সামনে পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত প্রমাণের জন্য যেসব পথ অবলম্বন করা হয়েছে তা এই দুটি সংবাদপত্রে পরিবেশিত সংবাদ, সংবাদ-বিশ্লেষণ, উপসম্পাদকীয় এবং সাক্ষাৎকারের মূল প্রতিপাদ্য। এও গ্রহণযোগ্য ছিল, কারণ প্রতিটি সংবাদপত্রের বা টেলিভিশন চ্যানেলের সম্পাদকীয় রীতি থাকে, এবং সেখানে যদি দেশের রাজনীতির এই অচলায়তন ভাঙার পক্ষে নীতি নির্ধারিত থাকে তাহলে কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম নিজেদের সেভাবে উত্থাপন করতেই পারে। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আলোচ্য সুশীল সমাজকে সঙ্গে নিয়ে এই দুই সংবাদ-মোড়ল নতুন একটি রাজনৈতিক দল খোলার পথে হাঁটছেন।

এই রাজনৈতিক দল খোলার জন্য তার নেতৃত্বকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যদিও তারা এই রাজনীতিটির সূত্রপাত ঘটিয়েছেন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যক্তিদ্বন্দ্ব, ব্যক্তিসংঘাত এবং তাদের পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে। একপক্ষকে যে দোষে অভিযুক্ত করে নিজেরা জনসম্মুখে হাজির হয়েছেন, একই কাজ করে তারা আবার নতুন রাজনীতি চালু করার চেষ্টা করছেন। দেশের মানুষ অচিরেই এই মিথ্যাচার এবং স্ববিরোধিতা ধরে ফেলতে সক্ষম হয়।

কিন্তু তার আগে বিশ্বময় বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যমে এই দুই সম্পাদকের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলায়তনকে ‘দুই বেগমের লড়াই’ (Battle of Two Begums), এবং দেশের ভেতর “দুই নেত্রীকে যেতে হবে” (কুখ্যাত মাইনাস টু ফর্মুলা) ধরনের প্রচারণার ঝড় তোলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধিসহ দেশের ভেতর পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা কখনও ‘টুয়েসডে ক্লাব’ কখনও ‘ব্রেকফাস্ট গ্রুপ’-এ মিলিত হয়ে ১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে শুরু করেন। এবং এসব আয়োজনে বাংলাদেশের পক্ষে নীতিনির্ধারক হয়ে অন্যদের সঙ্গে জড়িত থাকেন এই দুই সংবাদ-মোড়ল। এই বৈঠকগুলোতে নির্ধারিত নীতিগুলোই কখনও সংবাদ-বিশ্লেষণ, কখনও কেবলই সংবাদ, কখনও সাক্ষাৎকার হয়ে এই দুই সংবাদ-মোড়লের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, কখনও সেনা গোয়েন্দাদের হাত দিয়ে অন্যান্য সংবাদপত্রে প্রকাশে বাধ্য করা হয়, বশংবদ টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারের জন্য টকশো হোস্টদের হাতে ‘ম্যাটেরিয়াল’ নির্ধারণ করে দেওয়া থেকে অতিথিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং বিদেশি গণমাধ্যমে এদেরই বরাত দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও স্বার্থবিরোধী প্রচারণা জমে ওঠে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন কারাগারে, সংবাদমাধ্যমের রীতি অনুসরণ করে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ নেই কোথাও, তাদের একমাত্র পরিচয় তখন তারা এই কথিত সুশীল সমাজের দ্বারা ‘অভিযুক্ত’ এবং ‘কারাবন্দি’। কিন্তু কারাবন্দি এই নেতৃবৃন্দকে মুক্ত করার জন্য লড়ছে দেশের সাধারণ মানুষ, দলীয় সমর্থক, ছাত্ররা এবং কয়েকজন আইনজীবী।

সে বিচারে এই ১/১১-পন্থি কয়েকজন চিহ্নিত ব্যক্তি এবং দেশের সাধারণ মানুষ তখন রাজনৈতিকভাবে মুখোমুখি। মাঝখানে সেনাবাহিনী থাকায় মানুষ প্রাথমিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হলেও বাংলাদেশের মানুষ তো এরকম পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত এবং তারা এর থেকে উত্তরণের পথও জানে। সে জন্য যতটুকু ধৈর্য ও কৌশল দেখানোর সেটি তারা দেখিয়েছে এবং ১/১১-তে এই সুশীল কুশীলবরা যে পাশার দানটি দিয়ে ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি তাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, সেটি অচিরেই উল্টে গিয়ে দেখা গেলো দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ সেই পুরোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতেই আছে, প্রায় দু’বছর ধরে চলা এ খেলায় কেবল তারা দৌড়ঝাঁপই করেছেন, ক্ষমতাকে উপভোগই করেছেন, প্রকৃত ক্ষমতা ও রাজনীতি যে তখনও আসলে জেলের ভেতর থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতেই ছিল সেটি তারা ধারণাও করতে পারেননি। অনেক দেরিতে তারা সেটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, ভুল স্বীকার করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষ, মিডিয়া এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দূরত্ব এখন কয়েক আলোকবর্ষের সমান, যা কখনও ঘুচবে কিনা কে জানে। বর্তমান রচনায় এই সুদূরপ্রসারী ক্ষতিগুলো সম্পর্কে পাঠককে সম্যক ধারণা দেওয়াই প্রাথমিক দায় ও দায়িত্ব হিসেবে আমাকে তাড়িত করেছে ।

১/১১-এর কালে এই দুই সংবাদ-মোড়ল ও তাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত সংবাদপত্রদ্বয়ের ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের গণমাধ্যম। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অগ্রগতি ও উন্নতি যাই-ই বলি না কেন, সেটি সম্ভব হয়েছে সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব ও সমান্তরাল একটি স্পষ্ট ভূমিকার কারণে। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সংবাদমাধ্যম নিজেদের চরিত্র ও চিন্তাকে তার পাঠকশ্রেণির সামনে স্পষ্ট করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল দশকের পর দশক ধরে, এমনকি কঠিন স্বৈরশাসনের সময়েও। পাঠক তার পছন্দ মতো পত্রিকাকে বেছে নিয়ে তার গ্রাহক হয়ে এবং সংশ্লিষ্ট পত্রিকার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনাকে ধারণ করে বলা যায় শান্তিতেই ছিল। কিন্তু নব্বই দশকের শেষে এসে বাংলাদেশের এই কথিত সুশীল সমাজের রাজনৈতিক খিদেকে সন্তুষ্ট করতে আলোচ্য সংবাদ-মোড়লদ্বয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে করপোরেট হাউজের অর্থে, প্রচলিত রাজনৈতিক দলের বিপরীতে কথিত সুশীল রাজনীতিকে ধারণ করে এবং আপাতভাবে জনতুষ্টিবাদকে প্রাধান্য দিয়ে যে সংবাদমাধ্যমের রূপান্তর হয়, তাদের মূল চরিত্র ১/১১-এর আগে পাঠকের পক্ষে উন্মোচন সম্ভব হয়নি।

এই ১/১১-এর কালে এসে তাদের রাজনীতি, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, সেনাতোষণ এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য মানুষের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায় এবং এর ফলে দেশের গণমাধ্যমের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটি একটি বড় ধরনের ধাক্কা খায়। এটি ধারণা করা কোনোভাবেই অসংগত হবে না যে এই ধাক্কার ফলে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা এখন পর্যন্ত মেরামত করা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতে হবে কিনা কিংবা হলেও সেটা কতদিনে হবে সে বিষয়ে এখনই কিছু বলার সময় এসেছে বলে মনে করি না। তবে এ কথা জোর দিয়েই বলতে পারি, আজকে যে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই বলে আমরা দেশে-বিদেশে আলোচনা শুনি, তার একটি কার্যকারণ রয়েছে এবং এক্ষেত্রে ১/১১ কালপর্বে গণমাধ্যম তথা এই দুই সংবাদ-মোড়লের ভূমিকার রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ। অন্যত্র হয়তো এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে, কিন্তু এই লেখায় এ কথাটি শুধু বলে রাখতে চাই, ১/১১-এর সময়ে যদি তাদের ভূমিকা গণমাধ্যম তথা গণবিরোধী না হতো তাহলে আজকে আমাদের প্রতিবাদের কিংবা কথা বলার জায়গাটিও এতটা সংকুচিত হতো কিনা সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ভার আমি পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিলাম।

আমাদের এ কথা মানতেই হবে, গণমাধ্যমও যে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করতে পারে এরকম কোনও উদাহরণ বাংলাদেশে ছিল না। ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তির উদাহরণ থাকলেও পুরোপুরি ক্ষমতা দখল করে দেশের এত বছরের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলকে সরিয়ে নিজেরাই ক্ষমতাচর্চা করার মতো উচ্চাভিলাষী কোনও গণমাধ্যমের সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় ছিল না। ১/১১-তে এই সংবাদ-মোড়লের ভূমিকায় আমরা দেখতে পেলাম যে সংবাদপত্র অফিস থেকেই বঙ্গভবন কিংবা সেনাসদরে রাজনৈতিক পরামর্শ যায় (যে জন্য ডেইলি স্টারে কর্মরত একজন ম্যানেজিং এডিটরকে সে সময়কার সরকার-প্রধানের প্রেস অফিসারের পদও দেওয়া হয়েছিল, টেলিভিশনের সামনে এই ব্যক্তি ১/১১ সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনগণকে নিয়মিত ব্রিফিং দিতেন) এবং তাদের সেই পরামর্শকে নির্দেশনা মেনে সেসব বাস্তবায়ন করতেই কথিত সুশীল রাজনীতিবিদরা বাধ্য হন। গণমাধ্যমের এই পুরোপুরি ও ন্যাক্কারজনকভাবে রাজনৈতিক হয়ে ওঠার খেসারত দিতে হচ্ছে সব গণমাধ্যমকে। কারণ, এরপর থেকে সব গণমাধ্যমকেই সাধারণ মানুষ মনে করে এদেরও হঠকারী এবং স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এই অপরাজনীতির অচলায়তন থেকে বেরুতে দীর্ঘ সময় লাগবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। আরও একটি ভয়ংকর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে একটি স্থায়ী অনাস্থা ও বিরোধ তৈরি হওয়া। কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্বই এখন আর গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করেন না, আস্থা রাখেন না এবং অতীতে যে সম্পর্কের জোরে একটি রাজনৈতিক রিপোর্টার রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে পারস্পরিক আস্থার কারণেই একটি ‘স্কুপ’ বের করে আনতে পারতেন, এখন আর সেটি সহজে সম্ভব নয়। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এখন যে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সাংবাদিক, সম্পাদক এবং সংবাদপত্র সম্পর্কে কথা বলেন, তার মূল কারণ ১/১১-এর কালে এই সংবাদ-মোড়লের গ্রাম্য রাজনৈতিক ভূমিকা। আপনি প্রকৃত ও আদর্শিক রাজনৈতিক বিরোধ ও দ্বিমতকে ‘দুই বেগমর চুলোচুলি’ বলে শ্রেণিকরণ করবেন এবং দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী ও কথিত সুশীল সমাজকে তাদের প্রতিপক্ষ করে তুলবেন বিদেশি প্রেসক্রিপশনে এবং তারপরও মনে করবেন এই রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় গিয়ে কিংবা ক্ষমতার বাইরে থেকে আপনাদের সম্মান করবে, সেটা কোনও দেশে কোনোকালেই সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্থায়ীভাবে এই সম্মানটি হারিয়েছে এই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং তাদের জীবৎকালে কিংবা তাদের উত্তরসূরিরাও এই ঘৃণার মশালটি জ্বালিয়ে রাখবেন বলেই আশঙ্কা হয়।

তারা আরও একটি অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছেন ১/১১-এর কালে, আর তা হলো বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি আপাত দূরত্ব সৃষ্টি। সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার পেছনে রেখে নিজেরা যে দেশের ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন, সেটি উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় দেশের মানুষ আর সেনাবাহিনীর প্রতি আগের মতো সম্মান কিংবা ভরসার জায়গা হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত। গণমাধ্যমের সঙ্গে দেশের সেনাবাহিনীর সম্পর্ককে এরকম ‘রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রবণ’ করে তোলার জন্য তাদের সম্পূর্ণভাবে দায়ী করার মতো সাহসী অভিযোগটি আমি এই আলোচনায় জানিয়ে রাখতে চাই।

এই আলোচনায় উঠে এসেছে যে গণমাধ্যমের প্রতি ক্ষমতাসীনদের কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রাপ্তদের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ বাংলাদেশকে আজ একটি ‘বাকস্বাধীনতা-রহিত’ দেশ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত করে তুলছে। এর পেছনেও বড় ভূমিকা রয়েছে এই দুই সংবাদ-মোড়লের। সেটা কীভাবে হলো, সে সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে চাই এখানে। তাদের ১/১১-কালীন ভূমিকার কারণেই আজ রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ক্ষমতা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমের যে দূরত্ব ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা ঘোচার নয় এবং তাদের ভূমিকার কারণেই দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা-বিরুদ্ধ কিছু ‘কালাকানুন’ তৈরি হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে গণমাধ্যম ক্ষমতার জন্য বড় কোনও চ্যালেঞ্জ হয়ে না দাঁড়াতে পারে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোনও সরকার যদি এরকম কোনও আইন তৈরি করে তাহলে গণমাধ্যমই সবচেয়ে শক্ত ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়ার কথা। কিন্তু ১/১১-তে তাদের ভূমিকা এই শক্ত ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। আজকে গণমাধ্যমের ঐক্যহীনতা, ক্ষমতা-তোষণের প্রতিযোগিতা এবং সর্বোপরি ক্ষমতাহীন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হওয়ার প্রধান ও প্রধানতম দায় এই দুই সংবাদ-মোড়লের। তারা একটি ভয়ংকর ও ন্যাক্কারজনক পথে হেঁটে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে একটি কুয়োর ভেতর নিয়ে ফেলেছেন, সেখান থেকে খুব সহজে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের শক্তি সঞ্চয় করে প্রকৃত ও শক্তিশালী মর্যাদায় সহসা ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না। সে কারণেই এই দুই সংবাদ-মোড়লের কৃতকর্ম ও ১/১১-কালে তাদের প্রকৃত ভূমিকা উন্মোচিত হওয়া জরুরি। তাতে অন্তত বাংলাদেশের মানুষ এটা বুঝতে সক্ষম হবে যে তারা কোনও ভুল ও ভয়ংকর পথের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাইছিলেন।

গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দেওয়াটাই পৃথিবীময় শাসকদের একটি লক্ষ্য, গণমাধ্যম কোনও রাজনীতির কিংবা ক্ষমতার বন্ধু নয় কিন্তু তারা শত্রুও নয়, গণমাধ্যম সত্য উন্মোচনকারী এবং জনগণকে রাজনীতির সূত্র ও গতিকে ধরিয়ে দেওয়ার যোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশেও গণমাধ্যম সে কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে আজকের ক্ষমতাহীন, হাস্যকর এবং এলোমেলো অবস্থানে নিয়ে আসার দায় যে এই দুই সংবাদ-মোড়লকে নিতে হবে, সে কথা আমার মতো অনেকেই বলছেন কিন্তু তার পক্ষে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত একত্রিত করা সম্ভব হয়নি অনেকের পক্ষেই। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের একজন কর্মী হিসেবে আমার সুযোগ হয়েছে এই দুই সংবাদ-মোড়লের নিজস্ব ও তাদের সম্পাদিত পত্রিকাদ্বয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকারকে একত্রিত করার এবং সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম যে তাদের এসব ক্রিয়াকর্ম কোনোভাবেই সাংবাদিকতার রীতিনীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ তো নয়ই, বরং রাজনৈতিকভাবে উচ্চাভিলাষী এবং বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে নিজেদের একটি ব্যর্থ রাজনৈতিক শক্তির ক্যাডার হিসেবে প্রমাণ করেছেন। যার চরম নেতিবাচক ফল বর্তমানে আমরা সংবাদকর্মী, সম্পাদক এবং গণমাধ্যম ভোগ করছি এবং ভবিষ্যতেও ভোগ করতে হবে বলে মনে করি। যাদের অসাংবাদিকসুলভ কর্মকাণ্ড এবং ভূমিকা বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে এরকম প্রশ্নবিদ্ধ করলো তাদের পরিচয় এবং কর্মকাণ্ড গণমানুষের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে হয়তো একদিন এদের কারণে সাধারণের মনে যে ভুল অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে মুক্ত হওয়া গেলেও যেতে পারে। এই লেখাটি আসলে সেসব নেতিবাচক ও সাংবাদিকতার রীতি-বিরুদ্ধ ভূমিকার প্রতিবাদ বৈ কিছু নয়।

পরিশেষে, ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের ‘মোড়লগিরি’ নিয়ে জনমানসে, ঢাকার ক্লাবগুলোতে, এমনকি প্রশাসনেও বহুবিধ গল্প প্রচলিত রয়েছে। আমরা কয়েকজন উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেই সময়কালে এই দুটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, বিশ্লেষণ এবং সম্পাদকীয় ঘেঁটে দেখতে যে আসলেই তারা কী করেছিল এবং কী চেয়েছিল। এই তথ্য সন্নিবেশের কাজে যুক্ত করেছিলাম সাংবাদিকতার কয়েকজন প্রতিভাবান শিক্ষক ও সম্পাদককে। তারা পত্রিকা দুটি থেকে খুঁজে খুঁজে তাদের মতে উল্লেখযোগ্য লেখা এবং সে বিষয়ে তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সন্নিবেশিত করেছেন। এই লেখা তাদের সেই খোঁজাখুঁজির প্রয়াস থেকে উৎসরিত। এটি কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার শুদ্ধতা এখানে খুঁজতে চাইলে ভুল করা হবে- এ কথা আগেভাগে ঘোষণা করে নিয়েই বলতে চাই, এখানে সাংবাদিকতার কলাকৌশলকে ভিত্তি করেই তথ্যানুসন্ধান করা হয়েছে কেবল। কিন্তু আমার সরল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাঠক মনের ভাবনাকে জাগ্রত করা এবং পাঠকের নিজস্ব মতামত ও করণীয় নির্ধারণের সূত্র ধরিয়ে দিতে সহায়তা করা মাত্র। এই লেখা পাঠে একজন পাঠকও যদি আলোচ্য বিষয়ে অধিকতর জ্ঞানলাভে আগ্রহী হন এবং নিজেদের বিশ্লেষণী মতামত তৈরি করতে সক্ষম হন, অন্তত নিজের ভেতর তার নতুন ভাবনা-চিন্তা জাগ্রত হয়, সেটাই হবে এই রচনা প্রকাশে আমার সর্বোচ্চ সফলতা।

ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং আমার পরিবার এই মুহূর্তে একটি কঠিন সময় পার করছি। আমার অসহায়ত্ব এতটাই তীব্র যে আমার একাধিক পাণ্ডুলিপি কেবল সময়াভাবে সম্পাদনাহীন পড়ে আছে, পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারছে না, অথচ আমি মনেপ্রাণে সেগুলো পাঠকের হাতে তুলে দিতে আগ্রহী।

Share This Article

জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে

যে কারণে কারিনাকে অনেক বড় মনের মানুষ বললেন জয়দীপ

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বিএনপির শিক্ষা নেয়া উচিত: কাদের

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে অস্ত্র সমর্পণ করবে হামাস

দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি

বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের সুযোগ রয়েছে

বাংলাদেশে চিকিৎসা সুবিধায় থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী

মধুখালীতে সহোদর হত্যা : বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের উস্কানিতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত!

আপাতত রক্ষা পাচ্ছে ৩ সহস্রাধিক গাছ