খেলাপি ঋণ নবায়নে আবার বড় ছাড়

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:৪৪, মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০২২, ৪ শ্রাবণ ১৪২৯

খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ফের ঢালাও ছাড় দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এখন থেকে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫ থেকে ৮ বছরে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ তিন বছর সময় দেওয়া হতো। এ ছাড়া বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিল করতে পারবে। আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না।

 

 

গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত মাস্টার সার্কুলারে বড় ধরনের শিথিলতা আনা হয়েছে। এতে নিয়মিত মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগও দেওয়া হয়েছে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোভিড ২০১৯-এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নতুনভাবে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি

পাওয়ায় আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও খেলাপি ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ পুনঃতফসিল সংক্রান্ত নতুন সার্কুলার জারি করা হয়েছে।

ব্যাংক খাতে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এতে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ কমিয়ে আনা ও ডাউনপেমেন্ট গ্রহণের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এখন থেকে ঋণ পুনঃতফসিলের কোনো নথি ব্যাংকগুলোকে আর বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে না। নতুন নীতিমালা মেনে ব্যাংকগুলো নিজেরাই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে।

নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে, এ নীতিমালা ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের ন্যূনতম মানদ- হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন নীতিমালা প্রণয়ন করবে, যা তাদের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমাদিত হতে হবে। ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে এ নীতিমালায় বাইরে কোনো নমনীয় শর্তারোপ করা যাবে না। তবে নীতিমালাটিতে অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অথবা উৎপাদনশীল খাতের অলাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ থাকতে হবে।

এতে আরও বলা হয়, কোনো ঋণগ্রহীতার পুনঃতফসিল আবেদনের তিন মাসের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। কোনো গ্রাহক চেক, পে অর্ডার বা অন্য কোনো উপকরণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ডাউনপেমেন্ট হিসেবে প্রদান করলে তা নগদায়নের পর পুনঃতফসিলের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

সার্কুলার অনুযায়ী, মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ১০০ কোটি টাকার কম ঋণ সর্বোচ্চ ৬ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। ১০০ কোটি টাকা ও তদূর্র্ধ্ব কিন্তু ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণ ৭ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। আর ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্র্ধ্ব ঋণ ৮ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। চলমান ও তলবি ঋণের ক্ষেত্রে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকার কম ঋণ সর্বোচ্চ ৫ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব কিন্তু ৩০০ কোটি টাকার কম ঋণ ৬ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। আর ৩০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব ঋণ ৭ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। আর তৃতীয় ও চতুর্থ বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদি, চলমান ও তলবি ঋণে প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোচ্য মেয়াদ হতে যথাক্রমে ১ বছর করে কম হবে। যেমন- কোনো গ্রাহকের ঋণ হিসাব দ্বিতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭ বছর হতে তৃতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদ হবে ৬ বছর এবং চতুর্থবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ৫ বছর।

কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রথমবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৩ বছর এবং দ্বিতীয় ও তৎপরবর্তী প্রতিবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদ হবে ২ বছর ৬ মাস। ঋণের পরিমাণ বিবেচনায় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে গ্রেস পিরিয়ড হবে ৬ মাস। তবে গ্রাহকের ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় গ্রেস পিরিয়ডের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১ বছর নির্ধারণ করা যাবে।

ডাউনপেমেন্ট : মেয়াদি ঋণে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ১০০ কোটি টাকার কম ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউনপেমেন্টের পরিমাণ হবে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ৭ শতাংশ অথবা মোট বকেয়া ঋণের সাড়ে ৪ শতাংশ। ১০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব কিন্তু ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউনপেমেন্টের পরিমাণ হবে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ৬ শতাংশ অথবা মোট বকেয়া ঋণের সাড়ে ৩ শতাংশ। আর ৫০০ টাকা ও তদূর্ধ্ব ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউনপেমেন্টের পরিমাণ হবে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ৫ শতাংশ অথবা মোট বকেয়া ঋণের আড়াই শতাংশ।

চলমান ও তলবি ঋণে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকার কম ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউনপেমেন্টের পরিমাণ হবে মোট বকেয়া ঋণের ৪ শতাংশ। ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্র্ধ্ব কিন্তু ৩০০ কোটি টাকার কম ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউনপেমেন্টের পরিমাণ হবে মোট বকেয়া ঋণের শতাংশ, তবে ২ কোটি টাকার কম নয়। আর ৩০০ কোটি টাকা ও তদূর্র্ধ্ব ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউনপেমেন্টের পরিমাণ হবে মোট বকেয়া ঋণের আড়াই শতাংশ, তবে ৯ কোটি টাকার কম নয়।

আর তৃতীয় ও চতুর্থ বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদি, চলমান ও তলবি ঋণে প্রতিটি ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট আলোচ্য হারের চেয়ে যথাক্রমে ১ শতাংশের বেশি আদায় করতে হবে। যেমন- কোনো গ্রাহকের ঋণ হিসাব দ্বিতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউনপেমেন্টের হার সাড়ে ৩ শতাংশ হলে তৃতীয়বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে তা হবে সাড়ে ৪ শতাংশ এবং চতুর্থবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে তা হবে সাড়ে ৫ শতাংশ।

সার্কুলারে আরও বলা হয়, এ নীতিমালার আওতায় ঋণ পুনঃতফসিলের পর ঋণ স্থিতির ন্যূনতম ৩ শতাংশ কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট নগদে আদায়সাপেক্ষে নতুন ঋণ প্রদান করা যাবে। এ ছাড়া ঋণগ্রহীতার ঋণসীমাও বৃদ্ধি করা যাবে। তবে নতুন ঋণ মঞ্জুর বা ঋণসীমা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রাহক প্রকৃতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কিনা তা ব্যাংক কর্তৃক নিশ্চিত হতে হবে।

নিয়মিত মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ : নিয়মিত মেয়াদি ঋণগুলো বিদ্যমান অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে তা পুনর্গঠন করা যাবে। কোনো ঋণ হিসাবকে ঋণের মেয়াদের মধ্যে শুধু একবারই এরূপ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া যাবে। কোনো প্রকার ডাউনপেমেন্ট ছাড়াই মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে।

এর আগে ব্যাংক খাতে খেলাপির লাগাম টানতে গণছাড় দিয়ে ২০১৯ সালে খেলাপিঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়। ওই নীতিমালার আওতায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট আদায় সাপেক্ষে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল সুবিধা প্রদান করা হয়। ওই সুবিধা ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুবিধা বহাল ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ওই নীতিমালার আওতায় ২০১৯ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।

 

Share This Article