‘ঘড়ি কেনা’র ফাঁদে রয়েল চিটিং ডিপার্টমেন্টের প্রতারণা

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৫:০৬, রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ২ আশ্বিন ১৪৩০

চাঁদপুরের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জমি বিক্রি করার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। জমি ক্রয় করার আগ্রহ দেখিয়ে তাকে উত্তরার অফিসে ডাকে সংঘবদ্ধ রয়েল চিটিং ডিপার্টমেন্ট (আরসিডি)। সেখানে গিয়ে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের কথাবার্তার মধ্যেই আসে দামি রোলেক্স ঘড়ির ব্যবসার বিষয়।

ভারতীয় পার্টনারের সঙ্গে ঘড়ির ব্যবসায় লগ্নি করার কথা বলে একজন ৩০ লাখ টাকার বান্ডেল দিয়ে চলে যান। সাইফুলকেও ঘড়ি ব্যবসার পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। জমি বিক্রির পাশাপাশি ঘড়ির ব্যবসার লাভের প্রলোভনে পড়েন সাইফুল।


সঙ্গে যাওয়া ভায়রা আব্দুল মান্নানের সঙ্গে আলাপ করে পরদিন ২০ লাখ টাকা তাদের কাছে জমা দেন। এর পরদিন জমির রেজিস্ট্রেশনের হওয়ার কথা ছিল। সেদিন থেকে চক্রের সবার নম্বর বন্ধ। উত্তরার অফিসে গিয়ে চক্রের এক সদস্যকে পেয়ে আটক করে থানা পুলিশের খবর দেন সাইফুল।

এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ওই মামলার তদন্ত ভার পায় পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর)।

তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই চক্রের মোট তিন সদস্যকে গতকাল (১৬ সেপ্টেম্বর) উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তে পিবিআই জানতে পারে, বহুমাত্রিক ব্যবসার লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে ও প্রলোভন দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। চক্রের মূল হোতা আব্দুল বারী ওরফে আফসার উদ্দিন খাঁন ওরফে বজলুর রহমান মাসুদ (৬৬)। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা।


রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আগারগাঁও পিবিআই ঢাকা মেট্রো-উত্তর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, গত ৩০ জুলাই বিমানবন্দর থানা ও উত্তরা-পশ্চিম থানায় দায়ে করা প্রতারণার মামলার তথ্য মতে, মামলার বাদীর ছোট ভায়রা সাইফুল ইসলাম (৩২) ২৬ শতক জমি বিক্রির জন্য অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ার শরীফ নামে একজন জানান, তার মালিক আফসার উদ্দিন খাঁন (৬৬) জমি ক্রয় করবেন। তাদের জমির কাগজপত্র নিয়ে উত্তরা বিমানবন্দর থানার ১নং সেক্টরের ৬নং রোডের ৩নং বাড়ির ৪র্থ তলায় যেতে বলেন।

সাইফুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নান গত ১৭ জুলাই দুপুরে ওই ঠিকানায় যান ও জমির মূল্য নির্ধারিত হয়। জমির মূল্য নির্ধারণের পর ১৯ জুলাই হাজীগঞ্জ চাঁদপুর জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য যাবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। জমি-জমার কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর গ্রেপ্তার মোয়াজ্জেম হোসেন (৬৫) হঠাৎ করে আফসার উদ্দিন খাঁনকে বলেন, তার মালিক ভারতীয় নাগরিক। তিনি কিছু দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি ক্রয় করবেন। ঘড়ি দিতে পারলে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার নগদ ব্যবসা হবে। তখন মূল হোতা আফসার ও মোয়াজ্জেম ভারতীয় নাগরিক মালিককে আসতে বলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর এক লোক আসে। তাকে ভারতীয় নাগরিক ও ঘড়ি কেনার জন্য আসছেন মর্মে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

ভারতীয় নাগরিক পরিচয় দিয়ে ঘড়ি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে মূল হোতা আফসারকে ঘড়ি ক্রয় বাবদ অগ্রিম প্রায় ৩৫ লাখ টাকা প্রদান করেন এবং অবশিষ্ট টাকা পরদিন ১৮ জুলাই পরিশোধ করে ঘড়ি বুঝে নিয়ে যাবেন বলে চলে যান। পরবর্তীতে আফসার উদ্দিন খাঁন বাদী আব্দুল মান্নানকেও এই ঘড়ির ব্যবসায় পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দেন। পার্টনার হতে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। তাহলে আমদানিকারক ঘড়ি সরবরাহ করবে এবং সবাই সমানভাবে ব্যবসায় লাভবান হবেন।

সরল বিশ্বাসে ও তাদের আপ্যায়ন ও সমাদরে মুগ্ধ হয়ে আব্দুল মান্নান ও ছোট ভায়রা ভাই সাইফুল ইসলাম পরদিন দুপুরে একই স্থানে নগদ ২০ লাখ টাকা টাকা আফসারের হাতে তুলে দেন।

পরদিন জমি রেজিস্ট্রেশন হওয়ার কথা। কল দিয়ে সাইফুল ও মান্নান সবার নম্বর বন্ধ পান। বুঝতে পারেন সবই ছির পরিকল্পিত। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে মোয়াজ্জেমকে হাতেনাতে আটকে রেখে বিমানবন্দর থানায় খবর দেন। পুলিশ এসে মোয়াজ্জেমকে আটক করে। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রি তো দূরের কথা, ঘড়ির ব্যবসার ২০ লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় আফসারসহ চক্রের অন্য সদস্যরা। বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা মামলায় মোয়াজ্জেমকে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়।

বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর বলেন, পরবর্তীতে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর)। উপ-পরিদর্শক(এসআই) রবিউল ইসলাম মামলার তদন্তভার পাওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি রাশেদ ওরফে রাসেল (৩৭), মো. নাঈমকে (৪৩) গ্রেপ্তার করে।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চক্রের মূল হোতার আসল নাম আব্দুল বারী। তবে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকেন। তার তিনটি আইডি কার্ড আমরা পেয়েছি। একটায় আফসার উদ্দিন খাঁন, আরেকটায় বজলুর রহমান। তার বিরুদ্ধে মোট ৬টি প্রতারণা মামলার তথ্য মিলেছে। তিনি গত মাসেও আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে একই প্রতারণায় জড়িয়েছেন। তিনি অফিস পরিবর্তন করে আবারও উত্তরা পশ্চিম থানাধীন এলাকায় অফিস নেন। প্রতারণার ফাঁদ পেতে আবারও একজনের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মর্মে তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল রাতে সেই কথিত অফিস থেকে অন্য দুজনের সঙ্গে তাকেও পাওয়া যায়। তাদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জব্দ করা হয় বিভিন্ন দামী ব্র্যান্ডের হাত ঘড়ির ক্যাটালগ।

জিজ্ঞাসাবাদে আফসার জানান, তিনি বিমানবন্দর থানার মামলায় বিজ্ঞ আদালত থেকে জামিনে আছেন। তবে তার বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় পৃথক আরেকটি মামলা রয়েছে যেটিতে তিনি পলাতক। সেটিও পিবিআই তদন্ত করছিল। সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

পিবিআই এর এ কর্মকর্তা বলেন, এই রয়েল চিটিং ডিপার্টমেন্ট (আরসিডি) নামে প্রতারক চক্রের অন্যতম মূল হোতার আসল নাম আব্দুল বারী তিনি পরিচয় দিতেন বড় ব্যবসায়ী। কখনো ফার্নিচার, কখনো কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, কখনো ঘড়ির। আগে মালয়েশিয়ায় থাকতেন বারী। সেখান থেকে আসার পর ২০১৩ সাল থেকে প্রতারণায় নামেন। সুনির্দিষ্ট সদস্য নেই চক্রের। যখন যেখানে যাকে প্রয়োজন তাকে টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করতেন। এখন পর্যন্ত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্র। চক্রের আরেক হোতা মাসুদ পলাতক রয়েছে, তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

বিষয়ঃ অভিযান

Share This Article