মার্কিন ভিসা নীতির আদ্যোপান্ত: কি ভাবছে সরকার

★ নতুন ভিসা নীতি মোটেই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের স্যাংশন নয়।
★ এই নীতির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদান'র জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করতে সক্ষম হবে।
★ ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আমরা কাউকে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছি না। যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে, তারাই এর আওতায় পড়বেন।
★ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন 'যদি আমরা দেখতে পাই বিরোধী দলের কোনো সদস্য নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে সহিংসতায় জড়িত ছিলেন তাহলে তাকেও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না।
আগামী নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত রাজনৈতিক মাঠে সরকার বিরোধীরা যখন সরকারের বিরুদ্ধে নতুন মার্কিন স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা জারির সংবাদ পেতে আগ্রহী ছিল, এমন সময় আচমকাই ঘোষণা এলো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘ভিসা নীতি’। যেটি মোটেই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের স্যাংশন নয় বরং যা সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের ওপর প্রযোজ্য হবে। বিষয়টি প্রকাশ হতেই শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আইনের ধারা অনুসরণ করে বাংলাদেশিদের জন্য আলোচিত এই ভিসা নীতিটি ঘোষণা করেছে গত ২৪ মে, যেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনে বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ধারা ২১২ (এ) (৩)(সি) ("৩সি")-এর অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
উক্ত ঘোষণায় বলা হয়, এই নীতির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করা বা বাধাদান'র জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করতে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানানো হয়।
এছাড়া মার্কিন এই ভিসা নীতি সরকারি কিংবা বিরোধী দুই পক্ষের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য বলে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। একই দিন রাতে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই'র 'তৃতীয়মাত্রা' অনুষ্ঠানে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশিদের জন্য কেন এই ভিসা নীতি চালু করলো যুক্তরাষ্ট্র- এমন প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আমরা কাউকে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছি না। যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তারাই এর আওতায় পড়বেন। হোক সরকারের লোকজন কিংবা বিরোধী দলের কেউ।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন 'যদি আমরা দেখতে পাই বিরোধী দলের কোনো সদস্য নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে সহিংসতায় জড়িত ছিলেন তাহলে তাকেও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের 'ভিসা রেস্ট্রিকসন' বা ভিসা নিষেধাজ্ঞা কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের ওপর কার্যকরী হলে তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে আসেন এবং পরবর্তীতে এই নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধি পেয়ে দেশটির ট্রেজারি বিভাগ কতৃক সর্বোচ্চ নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে পড়েন। যার ফলে তিনি বা তার পরিবার আন্তর্জাতিক মানি ট্রানজেকশন'র বাধার মুখেও পড়েন।যেকোনো দেশের রাজনৈতিক বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত বিব্রতকর হয়ে ওঠে। আর এ কারণে বিএনপি বা যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব'র পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিকে এড়িয়ে চলা কষ্টসাধ্য বটে।
এদিকে ২৫ মে সকালে নতুন মার্কিন ভিসা নীতির বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি জোরালো সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা করছে বাংলাদেশ। এছাড়া মার্কিন ভিসা নীতি কার্যকর হলে
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কোনও চাপ অনুভব করছে না বলে জানিয়েছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী।
তারা বলছেন, নতুন এই নীতির সঙ্গে সরকারের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকারের মূলভিত্তিতে কোনো বিরোধ নেই। এমন নীতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ আরও সুগম হয়েছে বলেও দাবি দলটির শীর্ষ নেতাদের।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, নির্বাচন ঘিরে ‘মার্কিন ভিসা নীতি’ শেখ হাসিনার অঙ্গীকার আরও জোরদার করেছে। কেননা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বদ্ধপরিকর, যা মার্কিন মন্ত্রীর বক্তব্যেও এসেছে।এজন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপও নিয়েছেন তিনি। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনও গঠন করেছে তার সরকার। আর এসব কথাই নতুন নীতিতে ভিন্ন আঙ্গিকে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা আরও বলছেন, মার্কিন ‘ভিসা নীতিতে’ কিছুটা হলেও বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও কমবে। কেননা এই আইনের অধীনে তারা রয়েছেন। নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে সহিংসতার পথ বন্ধ হবে।
এদিকে ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা আসতেই নতুন করে হতাশা দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। মার্কিনিদের সমর্থন পেতে লবিস্ট নিয়োগ কিংবা কোটি টাকা খরচ করলেও নির্বাচন ঘিরে শেষমেশ এমন কিছু আশা করেনি মাঠের এই প্রধান বিরোধী দল। নিজেদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেবে বলেও স্বপ্ন দেখেছিলেন দলটির নেতারা।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো দ্বাদশ নির্বাচনেও না যাওয়ার পক্ষে কাজ করছিল বিএনপি। কেননা সরকারের অধীনে কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিল দলটি। এজন্য বিদেশিদের সঙ্গে দফায়-দফায় বৈঠক করেছেন নেতারা। কিন্তু মার্কিন এই নতুন সিদ্ধান্তে সরকাবিরোধী আন্দোলনে ভাটা ফেলবে। কেননা একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা আর অন্যদিকে নতুন মার্কিন ভিসা নীতির কারণে নির্বাচন বানচালে বাধা।এছাড়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্যও প্রস্তুত নয় দলটি।সব মিলিয়ে দলটি না পারবে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে আর না পারবে বানচাল করতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে সরকারের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল তা দূর করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার মাধ্যমে সব ধরনের অসুবিধাও দূর হয়েছে। এছাড়া চাইলেও এখন আর কেউ নির্বাচনে বাধা দিতে পারবে না। একই সঙ্গে অতিউৎসাহী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সতর্ক হবেন। তবে ঝুঁকিতে রয়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দল। তারা 'সরকারের ওপর আসন্ন নিষেধাজ্ঞা'র গুজব ছড়ালেও শেষ পর্যন্ত নিজেদের ওপরই তা আঘাত হেনেছে। তারা চেয়েছিল সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু হয়েছে 'হিতে-বিপরীত'।