ভুল বার্তা প্রেরণে শিশুর ব্যবহার: প্রথম আলোর দায়

(১)
সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তাদের শিশু সন্তানকে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের পর শিশুর মানসিক নিরাপত্তার প্রশ্নে আপত্তি তুলেছিলো শিশু ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন, এমনকি প্রথমআলোসহ বিভিন্ন পত্রিকাও।
(২)
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের প্রশ্ন করা বা প্রশ্নপত্র তৈরির বিষয়টি সবচাইতে স্পর্শকাতর বলে বিবেচিত হয়।
(৩)
বিজ্ঞাপন চিত্রে শিশুদের উপস্থাপন বা শিশুদের ব্যবহার করে কোনো বিষয় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করার বিধান রয়েছে।
(৪)
এমনকি ইলেকট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়ায় শিশুদের উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু বিধি বিধান মেনে চলতে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই তা আইনি কাঠামো বা পরিধিতে বিবেচনা করা হয়।
অথচ দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো একটি শিশুর ছবি ব্যবহার করে মানুষের আবেগকে উস্কে দিয়ে অর্থনৈতিক মানদন্ডে দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতাকেও।
শিশুটির ছবি ব্যবহার করে পত্রিকাটি বলেছে-‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো।’
স্বাধীনতা মানে কি শুধুই মাছ-মাংস দিয়ে খেতে পারা বা তিন বেলা পেট পুরে খাওয়া?
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে ব্রাকেটে সীমাবদ্ধ করার এমন হীন প্রচেষ্টা দুঃখজনক নয় ঘৃণ্যও বটে। কেননা স্বাধীনতা শব্দটি অনেক বিস্তৃত ও বহু উপদানে সমৃদ্ধ।
সংবাদিকতা নীতিমালায় আন্তর্জাতিকভাবে যে গাইডলাইন দেয়া আছে তা কোনো শিশুর ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা দাবি করে। শিশুর অভিভাবককে পরিপূর্ণভাবে তার কষ্ট, বেনিফিট ও রিস্ক সম্পুর্ন ব্যাখ্যা করে তার অনুমতি নিতে হয়। যে শিশুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তার বয়স সাত, ক্লাস ওয়ানের ছাত্র, পিতামাতার অনুমতি ছাড়া তার ছবি ব্যবহার করা সাংবাদিকতা নীতিমালার গুরুতর লঙ্ঘন।
এছাড়া আন্তর্জাতিক শিশুসনদ অনুযায়ী শিশু অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে যে ডিক্লারেশন রয়েছে (আর্টিকেল সিক্সটিন) তারও গুরুতর লঙ্ঘন। এমনকি প্রথম আলো ছবিটি যেভাবে ব্যবহার করেছে সেটি পাঠকদের সাথে প্রতারণারও শামিল।
অন্যদিকে শিশুকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তার বয়স, মনস্তাত্ত্বিক পরিপক্কতা, নিরাপত্তা বা ঝুঁকি, সবকিছু বিবেচনা করে করতে হয়। কিন্তু প্রথম আলো শিশুটিকে প্রশ্ন করা বা তার ছবি ব্যবহার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সকল নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে।
উল্লেখ্য, পলিটিক্যালী মোটিভেটেড সংবাদ প্রকাশের জন্য বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সম্পাদককে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। লন্ডনের নিউজ অব টাইমস পত্রিকাকে ‘মিলিয়ন ডলার’ জরিমানা গোনার কারণে দেউলিয়া হয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে সেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
বিশ্লেষকদের অভিমত, সাংবাদিকতা নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের ব্যতয় ঘটিয়ে একটি শিশুর হাতে ১০ টাকা ঘুষ দেয়া, তার ছবি ও নাম ব্যবহার করে ভুল ভাবে পরিবেশন করা, তাও আবার স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশ, কতটুকু লজ্জার ও নীতি বহির্ভুত কাজ! তা কি বোঝেনা প্রথম আলো কতৃপক্ষ, বা তাদের পক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা কথা বলছেন!
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যেসব দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রথম আলোর অপসাংবাদিকতাকে সমর্থন করছেন তারা নিজ দেশে একটি শিশুকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করলে তাকেও কি সমর্থন দিতেন? তার পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তেন? প্রশ্ন সর্ব মহলে।