রাজনীতিতে আগ্রহী খালেদা, তারেকের 'না'!

সুযোগ পেলে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতার চেয়ারে বসতে প্রস্তুত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। তবে সেই ক্ষমতায় যাওয়ার পথে প্রধান বাধা ছেলে তারেক রহমান।ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে থাকলেও তারেক মায়ের অসুস্থতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুরোপুরিভাবে বিএনপির শীর্ষ পদে আসতে মুখিয়ে আছেন। নিজের মতো করে বিএনপিতে একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।কিন্তুখালেদা জিয়া সক্রিয় হলেই এতদিনে গড়ে ওঠা একক নেতৃত্ব থেকে মাইনাস হয়ে যাবেন তিনি।তাই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তারেকের কপালে।
যেভাবে একক নেতৃত্ব হাতে পেলেন তারেক:
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবি হয় জেনারেল জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় রাজনীতির মাঠে আরও একবার হোঁচট খায় দলটি। এরপর বড় চ্যালেঞ্জের কবলে পড়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার কারণে।এ মামলার রায় ঘোষণার পর বেগম জিয়া ২০১৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন কারাগারে।
মূলত সেসময় থেকেই তারেক রহমান খালেদা জিয়াকে হিসেবের বাইরে রেখে দলীয় প্রভাব বিস্তারে সক্রীয় হতে থাকেন।এরপর ২০২০ সালে বর্তমান সরকারের নির্বাহী আদেশে বেগম জিয়া কারাগারের বাইরে আসলেও তার শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণের অজুহাতে লন্ডনে বসেই মায়ের কর্তৃত্ব নিজের করে নেন তারেক।
টানাপোড়েন শুরু:
দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাবার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন তারেক রহমান,যদিও নিজ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি এ পদের যোগ্য ছিলেন না।পরবর্তীতে গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে নিজের বৈধতা গ্রহণ করেন তারেক।এ নিয়ে দলের বাইরে এমনকি দলের অভ্যন্তরেই শুরু হয় সমালোচনা। খালেদা জিয়া নিজেও বিষয়টি নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকলেও দলে পারিবারিক কতৃত্ব বজায় রাখতে তিনি চুপ হয়ে যান।কিন্তু বেশিদিন না যেতেই বিভিন্ন ইস্যুতে শুরু হয় মা ছেলের দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন। বিশেষ করে মাকে অন্ধকারে রেখে তারেক জিয়া বিএনপির একাধিক নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করেন,এমনকি সুযোগ থাকার পরও দলীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তারেক মায়ের মতামত নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি এবং দলে খালেদা জিয়ার কাছের নেতাদেরও দূরে সরিয়ে দেন, যা নিয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায়ই বেগম জিয়া নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মাঝে অসন্তোষ থাকলেও তারেক রহমানের রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি।এরপর সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া নিজ বাসভবনে থাকার সুযোগ পেলেও অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং প্রকাশ্যে রাজনীতি করার বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও তারেক রহমানের অনীহার কারণে আড়ালেই রয়ে যান বেগম জিয়া।
পট পরিবর্তন:
বিগত কয়েক মাসের রাজনীতির পট পরিবর্তনে বিএনপির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু অনেকটাই ঘুরে গেছে।"খালেদা জিয়ার রাজনীতি করায় কোনো বাধা নেই" আইনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এমন বক্তব্যে নড়েচড়ে বসেছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, যার ঢেউ লেগেছে বিএনপির তৃণমুল নেতাকর্মীদের মাঝেও।দাবি উচ্চারিত হচ্ছে বেগম জিয়াকে প্রকাশ্যে আনার।
তারেকের 'না':
,খালেদা জিয়ার রাজনীতি' ইস্যুটি সামনে আসার পর তৃণমূলসহ অধিকাংশ নেতাকর্মীদের চাপের প্রেক্ষিতে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়ার সাথে দেখা করেন আলোচনার জন্য।প্রায় সকল নেতাই এখন তার বাসভবন 'ফিরোজা মুখী।' কিন্তু বেগম জিয়ার প্রতি নেতা-কর্মীদের এমন আকর্ষণকে ভালোভাবে নিতে পারছেননা তারেক।
সূত্রমতে, বেগম জিয়ার মৌন সম্মতিতে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিষয়টি তারেক রহমানকে অবহিত করলে তিনি সরাসরি তা নাকচ করে দেন। আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে সরকারের 'ফাঁদ' আখ্যায়িত করে তারেক বেগম জিয়াকে নির্বাচনের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে বিএনপির একটি সূত্র।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া:
তারেক রহমান নাকি খালেদা জিয়া, কার নেতৃত্বে চলবে বিএনপি, এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে এখনও চলছে আলোচনা, রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত।দলের প্রবীনরাসহ অনেকেই এখনও পড়ে রয়েছেন খালেদা জিয়ার ফিরোজা বাসভবনে। তারা সেখানে নিয়মিত যাচ্ছেন।তৃণমূল কর্মীরাও প্রতিদিনই আগ্রহ নিয়ে ভিড় করছেন।তারা চাচ্ছেন, খালেদা জিয়া আবারও সক্রিয় হোক।সরাসরি নেতৃত্বে আসুক।
কিন্তু আরেকটি পক্ষ তারেক জিয়ার পরামর্শ মেনে বেগম জিয়াকে পেছনে রেখে তারেক জিয়ার নেতৃত্বেই আস্থা রাখছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন,দীর্ঘদিন দলটির চেসরপার্সন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই তারেক রহমান প্রভাব বিস্তার করছেন, এটা সত্য।এর বিকল্প তখন হয়তো ছিলোনা।দলে জোর অসন্তুষ্টি থাকলেও নেতাকর্মীরা তা মেনে নিয়েছেন এবং সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে দলে তার শক্তিশালী অবস্থানও তৈরী হয়েছে।ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা চাইলেও এখন সহসাই তাকে সরিয়ে বেগম জিয়াকে একক নেতৃত্বে আনা সম্ভব হবেনা।
তবে দীর্ঘদিন দল পরিচালনা করলেও জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিভিন্ন কারণে ভারত ও মার্কিনিদের বৈরী মনোভাব এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন না থাকায় দলের অনেকেই তারেককে সরিয়ে বেগম জিয়াকে এখনই সামনে আনতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু অভ্যন্তরীন কোন্দল ও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত দলটির মাঝে খালেদা-তারেক নেতৃত্বের নতুন দ্বন্দ্ব দলটিকে আরও কঠিন সমস্যায় ফেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।