বাংলাদেশের সীমাহীন হুমকির রাজনীতি

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ রাত ১০:২০, রবিবার, ১২ জুন, ২০২২, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯

বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুমকি যেন অন্তহীন। বিরোধী দলের একজন শীর্ষ রাজনীতিবিদ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘’১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তির’’ আহ্বান জানিয়েছেন, যা তার রাজনীতির দেউলিয়াত্বের ইঙ্গিত করে। এটি অবশ্যই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আভাস বহন করে।

বাংলাদেশে সহিংস সামরিক অভ্যুত্থানের এক সাক্ষী ১৯৭৫ সাল। এই সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার প্রায় পুরোপরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সরকারের চূড়ান্ত পতন ঘটে এই ১৯৭৫ সালেই।

সেই অভ্যুত্থানের ফলে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক শাসন শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। জেনারেল জিয়া বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বন্দুকের নলে ক্ষমতাকে রাজনৈতিকভাবে বৈধ করে নেন।

বিএনপির অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক কাদের ভূঁইয়া এক বিক্ষোভ সমাবেশে “১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি”র আহ্বান জানিয়ে স্লোগান দেন। যে আহ্বানে বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতা বিরোধিতা করেনি, যা রাজনীতিতে একটি নির্লজ্জতার দৃষ্টান্ত।

সুদূর লন্ডন থেকে, জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ওয়েব কনফারেন্সের মাধ্যমে ক্যাডার বাহিনী বাড়ানোর জন্য দলীয় নেতাদের আহ্বান জানান। এমনকি বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামীর নেতারা “ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সরকার” এর দাবি জানিয়ে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেছে।

১৯৭৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একাধিক হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশুণ্য করায় লিপ্ত হয়েছিল একটি চক্র। তাদের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। সেই লক্ষ্যে শেখ হাসিনার ওপর একাধিকবার গ্রেনেড হামলাও করা হয়। ২০২২ সালেও তারা ক্ষান্ত হননি। তারা “১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি” চাইছেন। স্বাধীনতার পর যারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তারা এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা বাংলাদেশে ব্যাপক সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে চায়।

পরিহাসের বিষয় হল পশ্চিমারা মানবাধিকারের কথা বলে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে বিরোধী শক্তিগুলোকে আওয়ামী লীগের শিকার বলে তাদের উৎসাহিত করতে চায়। পশ্চিমারা নিজ দেশে মানবাধিকার সুরক্ষা না করতে পারলেও অন্য দেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে বেশ সরব থাকেন।

পশ্চিমাদের এমন দ্বৈত নীতির সমালোচনা করেছেন এশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী চন্দ্রন নায়ার। তিনি পশ্চিমাদের মানবাধিকারকে “শ্বেত বিশেষাধিকার” হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শশী থারু দুজনই কয়েক মাস ধরে পশ্চিমা আইন ও শাসনের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে বন্দুক হামলায় নিহতের ঘটনাগুলো সমালোচনা করেন তারা।

মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে জয়শঙ্কর আমেরিকার এক টক শোতে অংশ নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার আহবান জানান। একই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের দ্বারা সংখ্যালঘু এলাকায় নিরপরাধ মানুষদের গণহত্যা করা হচ্ছে বলেও ইঙ্গিত করেন তিনি।

এখন বাংলাদেশেরও সময় এসেছে “শ্বেতাঙ্গ অধিকার”কে চ্যালেঞ্জ করার। পশ্চিমাদের ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের শেষ দিনে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে হত্যাসহ ৩০ লাখ গণহত্যাকারী রক্তপিপাসু পাকিস্তানী শাসনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সমর্থন করেছিল। সেই বিষয়টি মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো আমেরিকাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে বাংলাদেশকে।

ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১৯৭১ সালের নৃশংসতাকে ভয়ঙ্কর বলে বর্ণনা করে ওই সময়ে আমেরিকার সমর্থনকে সংশোধন করতে চাইছেন। কিন্তু ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তার দেশ বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিষয়ে কোন শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন না পিটার হাস।

বিএনপি নেতারা এখন যে ধরনের সহিংস রাজনীতির আহ্বান জানাচ্ছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। তারা আবারও ইতিহাসের ভুল পথে চলে গেছে। মানবাধিকারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা তাদের একটি কৌশল মাত্র। বাংলাদেশেও তারা এমন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে যা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে করেছে।

২০১৩-১৬ সাল পযন্ত ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদকে দমন করায় দায়ে বাংলাদেশ পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা খুবই হতাশাজনক। আসলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষমতা পরিবর্তনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পদ্মাসেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার জন্য বাবার মতো শেখ হাসিনাকেও তারা শাস্তি দিতে চায়।

তবে তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। বৈশ্বিক বাস্তবতা এখন শুধু পশ্চিমাদের থেকে রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা নয়, বাকি বিশ্ব থেকেও পশ্চিমারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা প্রস্তাবের পক্ষে কতগুলো দেশ ভোট দিয়েছে তা দেখলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই বাংলাদেশের এখনই সময় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য পদক্ষেপকে পাত্তা না দেয়া। এমনকি নিরপেক্ষ নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাশিয়ার তেল কেনার বিষয়ে পশ্চিমাদের দমককে ভয় না পাওয়া।

ভারত যেমন প্রথমে পররাষ্ট্রনীতির ওপর জোর দিচ্ছে, যা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রশংসাও পেয়েছে। তেমনি শেখ হাসিনারও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির ওপর জোর দেওয়া উচিত। তবে বিএনপি নেতারা “১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি” যে হুমকি দিচ্ছে সেই বিষয়টিও আমলে নিয়ে তা সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। তবে পশ্চিমারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে সমালোচনা করে সেদিকে নজর না দিলেও চলবে। কারণ প্রতিষ্ঠা থেকেই সহিংস রাজনৈতিক-সামরিক শাসনের সঙ্গে জড়িত পাকিস্তান (পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান)।

২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও যুক্তরাজ্য তারেক রহমানকে আশ্রয় দিয়ে নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও উত্তর আমেরিকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরকে আইনের ফাঁকফোকরের আড়ালে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে এই দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে দমন করা ও শক্তি প্রয়োগের অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে।

গণতন্ত্র মানেই অহেতুক সংকট ও সহিংসতা তৈরি করা নয়। তাই সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য “১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি”র যে আহ্বান বিরোধীরা করছে তা শক্তভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে গত ১২ বছরে অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ও মানব উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। বিডি নিউজ থেকে অনূদিত।

লেখক: সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। উপমহাদেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। ১৯৬৪ থেকে ২০০৩, প্রায় চার দশক কাজ করেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। এছাড়া বিভিন্ন সময় দায়িত্বে ছিলেন বম্বে ব্লিৎজ, দুবাই গালফ নিউজ, বিবিসি রেডিওতে। আনন্দবাজারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামকে প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে। পেয়েছেন বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত মুক্তিযুদ্ধের ‘বন্ধু-সমর্থক’ সম্মাননা।

Share This Article


ফের বিএনপি জামায়াত সম্পর্ক: উদ্বিগ্ন বিদেশি কূটনীতিকরা

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে বাড়বে গোপন তৎপরতা, মত শিক্ষাবিদদের

প্রসঙ্গ বুয়েট: ছাত্র রাজনীতি বন্ধের প্রচেষ্টা দেশের জন্য স্থায়ী অকল্যাণ বয়ে আনবে

বেগম জিয়ার ঘনঘন ‘ফিরোজা টু এভার কেয়ার’ রহস্য উন্মোচন!

যে কারণে অপসারণের আগেই গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস

মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন নয়, 'মাইনাস টু ফর্মুলা’র জনক ছিলেন ইউনূস!

ড. ইউনূসের পক্ষে আইনকানুন ও যুক্তির ব্যবহার নেই, আছে আবেগের বাড়াবাড়ি

আর রাখঢাক নয়: ফের প্ৰকাশ্য হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক!

ঈদকে সামনে রেখে আগত মৌসুমী ভিক্ষুকদের সাথে রিজভীর সাক্ষাৎ!

শামীম ইস্কান্দারের প্রশ্ন : খালেদা জিয়ার স্বার্থেই কি বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারতোনা?

আল্লাহ কার কথা শুনবেন: ইউনুসের নাকি নির্যাতিত ঋণ গ্রহীতাদের?

নোবেল কমিটি জানতো ইউনূসকে, জানতোনা ক্ষুদ্র ঋণের আদ্যোপান্ত !