পদ্মা সেতুর ব্যয় বিতর্ক পদ্মা সেতু বনাম ভূপেন হাজারিকা সেতু

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:৪৬, সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২, ১৭ শ্রাবণ ১৪২৯

সায়্যিদ চৌধুরী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও মোঃ আবদুর রশিদ সরকার : 

(ক) ভূপেন হাজারিকা সেতুর সঠিক এবং সর্বমোট ব্যয়ের হিসাব পাওয়া সম্ভব হয়নি। নির্মাণকালে গণমাধ্যমে সেতুর প্রাথমিক ব্যয় ১,১০০ কোটি ভারতীয় রুপী বলা হয়। তবে ২০১৭ সালে উদ্বোধনকালে এর ব্যয় ২,০৫৬ কোটি ভারতীয় রুপী উল্লেখ করা হয় (তথ্যসূত্র : ইকোনমিক টাইমস ও দৈনিক দ্য হিন্দু)। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তির মাধ্যমে নির্মিত সেতুতে ভারত সরকারের অর্থ বিনিয়োগ ছিল কি-না জানা যায়নি।

 তবে সেতুর জন্য ব্যবহৃত সর্বমোট ৩০,০০০ টন স্টিল সরকারী মালিকানাধীন স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড সরবরাহ করেছে (পদ্মা সেতুতে স্টিল ব্যবহার হয়েছে ২,৮২,০০০ টন)।

২০০৭ সালে ১/১১ আমলে জাপানি অর্থায়নে এবং জাইকার তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত একটি প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডির ভিত্তিতে কোন প্রকার ডিটেইল ইনভেস্টিগেশন বা ডিজাইন ছাড়াই ৫.৫৮ কি.মি. সড়ক সেতুর জন্য ১০,১৬২ কোটি টাকার সম্পূর্ণ আনুমানিক ব্যয়ের ভিত্তিতে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার ২০২২

(খ) আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এই ৫.৫৮ কি.মি. শুধু সড়ক সেতুর (যার ডিজাইন হয়নি বা পদ্মা নদীর তলায় ফাউন্ডেশনের চ্যালেঞ্জ ও নদী শাসনের ব্যয় সম্পর্কে বিশদ তথ্য ছিল না) অনুমিত ১০,১৬২ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয়কে ভিত্তি করেই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ২০০৯-২০১০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে কনসালটেন্টস মনসেল এরকম সেতুর ডিজাইন প্রস্তুতের কাজ শুরু করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সেতুতে রেল সংযোগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ডিটেইল ডিজাইনের সময় কারিগরি কারণেই সেতুর দৈর্ঘ্য ৫৭০ মি. বেড়ে ৬.১৫ কি.মি. হয় এবং রেল সেতু যুক্ত হওয়ায় নদীর তলদেশে মাটির সঠিক অবস্থা অনুযায়ী পাইলিং ডিজাইনের কারণে ফাউন্ডেশন ব্যয়ও আগের অনুমানের চেয়ে বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

(গ) এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অনুমোদিত নকশা এবং ২৯৭.২০৬ কোটি মার্কিন ডলারের এস্টিমেট অনুযায়ী ২০১১ সালে একটি প্রকল্প প্রস্তাব সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এটিই পদ্মা সেতুর গ্রহণযোগ্য প্রথম অনুমোদিত ব্যয়। ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য বিভিন্ন বহুপাক্ষিক সংস্থা যথাÑ বিশ্বব্যাংক, এডিপি, জাইকা, আইডিবির সঙ্গে ২৯৭.২০৬ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে সময় ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮.৬৫ টাকা। সে হিসাবে ২৯৭.২০৬ কোটি মার্কিন ডলার দাঁড়ায় ২০,০০০ কোটি টাকার ওপরে। কয়েক দফা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের পর ২০১৪ সালের নবেম্বরে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে মূল সেতু নির্মাণের জন্য ১২,১৩৩.৩৯ কোটি টাকায় চুক্তি সম্পাদিত হয়। অনুরূপ একই বছর ডিসেম্বরে চীনের সাইনো হাইড্রো কর্পোরেশনের সঙ্গে নদী শাসনের জন্য ৮,৭০৮ কোটি টাকার চুক্তি হয়। এই দুটি চুক্তির মোট মূল্য ২১,৫৩৩.৩৯ কোটি টাকা, যা ২০১১-এর এস্টিমেটেড ব্যয়ের চেয়ে ১,৫০০ কোটি টাকা বেশি।

চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও সাইনো হাইড্রো সম্পূর্ণ চীন সরকারের মালিকাধীন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে (যথাক্রমে সেতু ও ড্যাম নির্মাণে) বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালে সেতুর আনুষঙ্গিক কাজের জন্য (যেমনÑ মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ১২ কি.মি. সংযোগ সড়ক, অন্যান্য স্থাপনা ও সার্ভিস এরিয়া) মোট প্রায় ১,২৯১ কোটি টাকার চুক্তি হয়। নির্মাণ কাজ চলাকালীন ফাউন্ডেশন (পাইলিংসহ) ডিজাইন সংশোধন, নদী শাসনের পরিধি বৃদ্ধি, অধিক ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের আইন সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী বাজারমূল্যের ওপরে ৫০% প্রিমিয়ামসহ ক্ষতিপূরণ প্রদান, পুনর্বাসনের প্লট বিতরণ, বাড়ি নির্মাণ, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাটবাজার এবং অন্যান্য অবকাঠামোসহ সাতটি টাউনশিপ নির্মাণ ও অন্যান্য কারণে প্রকল্প ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এসব খাতে ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪,৭৫০ কোটি টাকা। এসবের বিশদ কারণ বা যৌক্তিকতা এবং আইটেমওয়ারী টাকার পরিমাণসহ যাবতীয় তথ্য বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। সংক্ষেপে কারণগুলো হচ্ছে-

ডুয়্যাল গেজ রেললাইনসহ দ্বিতল মূল সেতুর ব্যয় ৮,৩৬১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১২,১০০ কোটি টাকা, ১৬ কি.মি. (মূল চুক্তিতে ১৪ কি.মি.) নদী শাসন কাজে ৮,৭০৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৯,৪০০ কোটি টাকা, পুনর্বাসনে ৩০৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১,৫০০ কোটি টাকা, জমি অধিগ্রহণ ১,১২৩ হেক্টর থেকে বেড়ে ২,৭০০ হেক্টর হওয়ায় জমি অধিগ্রহণে ২,৭০০ কোটি টাকা, ১২ কি.মি. দীর্ঘ ৬ লেন সংযোগ সড়ক নির্মাণে অতিরিক্ত কাজের জন্য ১,৫৮৩ কোটি টাকা বেড়ে ১,৯০৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়াও পরামর্শক, সেনা নিরাপত্তা, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও অন্যান্য অতিরিক্ত ব্যয় ২,৫০০ কোটি টাকা।

নদীর তলদেশে মাটির অবস্থা খারাপ হওয়ায় প্রতি পিলারের নিচে ৬টির পরিবর্তে ৭টি ১২২-১২৫ মিটার দীর্ঘ পাইল প্রোথিত হয়েছে এবং ২২টি পিলারের পাইলে উচ্চমূল্যের আমদানিকৃত মাইক্রোফাইন সিমেন্ট দ্বারা স্কিন গ্রাউট করতে হয়েছে। এছাড়াও সেতুকে সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় করার জন্য ব্যয়ও নির্মাণকালে বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মা সেতুতে ব্যবহার হয়েছে এ যাবতকালের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং।

পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের ৫০% থেকে ৬০% বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয় করতে হয়েছে (কনসালটেন্টদের ফি, নির্মাণ সামগ্রী ও ভারি যন্ত্রপাতি আমদানি, বিদেশী কন্ট্রাক্টরদের বিল, যন্ত্রপাতি ক্রয়, ভাড়া ইত্যাদি)। নির্মাণকালে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি (৬৮.৮৫ টাকা থেকে প্রায় ৮৫ টাকা বা ২৪% বৃদ্ধি) সেতুর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। এর ভিত্তিতে হিসাব করলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অনুমোদিত ২৯৭.২০৬ কোটি মার্কিন ডলারের ৫০%-এর ওপর ২৪% বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে প্রকল্প ব্যয় অন্তত ৩,০৬০ কোটি টাকা বেড়েছে। প্রকল্প ব্যয়ের ৬০% বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধযোগ্য হলে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ৩,৬৭২ কোটি টাকা।

(ঘ) পদ্মা সেতুর অনন্য বৈশিষ্ট্য, নদীর গতি-প্রকৃতি, নির্মাণের স্কোপ বৃদ্ধি, নির্মাণ সামগ্রীর ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হারের উর্ধগতি আমলে নিলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়কে অত্যধিক বলা অসমীচীন। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অনুরূপ বড় সেতুর তুলনায় পদ্মা সেতুর খরচ খুব বেশি নয়। অধিকন্তু এই প্রকল্পের রিটার্ন প্রায় ২১%, যা বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রায় দ্বিগুণ (তথ্যসূত্র : ডেইলি স্টার গোল টেবিল, ১০ জানুয়ারি, ২০১৬)।

পাশ্চাত্যের উন্নত দেশেও নির্মাণকালীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার মেগা প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির উদাহরণের অভাব নেই। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ড. মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল এরূপ একটি উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি নিজে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকো ওকল্যান্ড বে ব্রিজের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ইস্টার্ন স্প্যানের পুনর্নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে প্রকল্পের এস্টিমেটেড ব্যয় ছিল ১ বিলিয়ন ডলার। ২০০২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০১৩ সালে তা শেষ হয়। ততদিনে নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (তথ্যসূত্র : ড. আউয়াল, প্রথম আলো (ইংরেজী), ২০ জুন, ২০২২)।

উপসংহার

ডিজাইন ও নির্মাণে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সেতু নির্মাণে কয়েকটি বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের যোগাযোগ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক যুগের সূচনা করেছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জিডিপিকে প্রতিবছর ১.২% হারে বৃদ্ধি করবে। প্রথম বছর এর পরিমাণ আনুমানিক ৪২,০০০ কোটি টাকার বেশি।

সেতু বিভাগ অর্থ বিভাগ থেকে ১% সার্ভিস চার্জে ধার নেয়া ৩০,১৯৩ কোটি টাকা ৩৬ বছরে পরিশোধের কথা থাকলেও টোল আদায়ের হার থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, ২৫ বছরেই সেতু নির্মাণের ব্যয় উঠে আসবে। খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুর বিভাগের বিস্তীর্ণ জনপদ ও শহরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ দ্রুততর করা ছাড়াও ঢাকা-কলকাতার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও দ্রুততর করবে এই সেতু। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সাড়ে তিন কোটি মানুষ ছাড়াও সারাদেশই এই সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে।

বিশ্বব্যাংকের সূত্র উদ্ধৃত করে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পদ্মা সেতুর রাজস্বের পরিমাণ আগামী ৩১ বছরে হবে ১৮.৫ বিলিয়ন ডলার, যা সেতু নির্মাণের ব্যয়ের ৫.৫ গুণ (তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ২৫ জুন, ২০২২)।

বিশেষজ্ঞদের মতে পদ্মা সেতুর প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের দারিদ্র্য কমবে ১.০১ শতাংশ এবং জাতীয় ক্ষেত্রে ০.৮৪ শতাংশ। এসব তথ্য প্রমাণের পর পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে অহেতুক বিতর্কের অবসান হওয়া আবশ্যক।

লেখকবৃন্দ : প্রকৌশলী ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া/ অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া/ অর্থনীতির অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

Share This Article


‘বিএনপি নেতাদের স্ত্রীরা যেন ভারতীয় শাড়ি না পরেন’

কোনো মেজরের বাঁশির ফু-তে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি : প্রধানমন্ত্রী

স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিকে পুতিনের শুভেচ্ছা

সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ

আমরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আছি: শেখ হাসিনা

‘আমরা খাওয়া বাদ দিয়ে দেওয়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছি’

১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিলেন প্রধানমন্ত্রী

১০ বিশিষ্টজনের হাতে স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী

সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

গাজায় হত্যাকাণ্ড বন্ধে পদক্ষেপ না নেয়া দুঃখজনক: প্রধানমন্ত্রী

গাজায় হত্যাকাণ্ড বন্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেয়া দুঃখজনক : প্রধানমন্ত্রী

ভারতীয় পণ্য বর্জন করে বাজার ব্যবস্থা কি ঠিক রাখা যাবে