ডেঙ্গু পরিস্থিতি
শিশুদের নিয়ে বড় ভয় ‘শক সিনড্রোম’

ধরন বদলে এখন ভয়ংকর চেহারায় ডেঙ্গু। এবার সবচেয়ে বিপদে পড়ছে শিশুরা। অধিকাংশ শিশু জ্বর ছাড়াই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের শারীরিক অবস্থা জটিল হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে দেরিতে আসায় অধিকাংশ শিশুর ‘শক সিনড্রোম’ দেখা দিচ্ছে। আগের বছরগুলোর চেয়ে এ প্রবণতা এবার অনেক বেশি; যা নিয়ে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুসংখ্যার নতুন রেকর্ড হয়েছে। এক দিনেই মারা গেছেন ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ছয়জন। আক্রান্ত হয়েছেন ৮৩৬ জন। এটিই বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্ত। এর আগে ৪ জুন পাঁচজনের মৃত্যু সংবাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত শনিবার ৮২০ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ে যাঁরা হাসপাতালে আসছেন, তাঁরা শুরুতে আসছেন না। ডেঙ্গু হয়েছে কিনা বুঝতে না পেরে, জ্বরের নানা চিকিৎসা নিতে থাকেন। ফলে অবস্থা জটিল হয়ে যায়, এরপর তাঁরা হাসপাতালে আসেন। যে কারণে শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ থাকে। হঠাৎ ‘শক সিনড্রোম’ দেখা দিলে রোগী বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়। অনেককে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নিতে হচ্ছে। সুস্থ হতে বেশিরভাগ রোগীর ৬ থেকে ৮ দিন থাকতে হচ্ছে। কারও কারও ১০ দিনও লেগে যাচ্ছে।
এদিকে গতকাল রোববার মানিকগঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, বৃষ্টি হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে পানি জমে মশার বংশবিস্তার হয়েছে, ফলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভাকে আহ্বান করছি, তারা যেন বেশি বেশি করে স্প্রে করে। যেসব স্থানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে তা অপসারণ করতে হবে। এই পানি না সরালে আগামী দুই মাসে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
বেশি বিপদে শিশুরা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ব্যবসায়ী রেদোয়ানের ৭ বছরের ছেলে হায়দার চৌধুরী তিন দিন ধরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ভর্তি। রেদোয়ান বলেন, ছেলের হঠাৎ জ্বরের সঙ্গে বমি ও বাম চোখে রক্ত জমে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে ডেঙ্গু। চিকিৎসক জানিয়েছেন, হঠাৎ শক সিনড্রোম দেখা দেওয়ায় তার প্লাটিলেট কমে গেছে। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এখন জ্বর কিছুটা কমেছে, তবে শঙ্কামুক্ত নয়। হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে একটু এগোতেই দেখা গেল শিশু আব্দুল সাহাল কাঁদছে। তার বাবা আতিকুর রহমান বলেন, জ্বর দেখা দেওয়ার এক দিন পরই হাসপাতালে ভর্তি করেছি। তবু চিকিৎসক জানিয়েছেন, দেরিতে হাসপাতালে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩৮ শিশু ভর্তি আছে, এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ১২ শিশু। আইসিইউতে আছে ৬ জন। এদের অবস্থা খুব জটিল। জুলাইয়ের শুরু থেকে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে অতিরিক্ত চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগেও। গত ১৫ দিনে ৬০ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এই বিভাগে ডেঙ্গু রোগীর জন্য রয়েছে আলাদা কর্নার, শিশুদের জন্য আছে আলাদা আইসিইউ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. শাকিল আহমদ বলেন, সাধারণ জ্বর-সর্দি ছাড়াই শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। কিছু রোগীর জ্বর সেরে জটিলতা বাড়ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগ শকে চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের টিম ২৪ ঘণ্টা এসব রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, কাঁপুনি দিয়ে জ্বরের সঙ্গে শিশুদের সর্দি-কাশি হলে যেন কভিড পরীক্ষা করা হয়। তেমনি ডেঙ্গু পরীক্ষাও করাতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর শুরুতে জ্বর আসে, মাথাব্যথা হয়, শরীর, চোখ ও পেটব্যথা করে। অনেকের বমি হয়। প্রায় চার দিন টানা জ্বর থাকার পর কমে যায়। তখন থেকে ডেঙ্গুর কমপ্লিকেশন যেমন প্লাজমা লিকেজ, পেটে-বুকে পানি জমা ও রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। হেমোরেজিক বা দাঁত, নাক, ফুসফুস ও পায়খানার সঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়। অনেক শিশু চেতনা হারাতে পারে। এভাবে নানা উপসর্গ নিয়ে শক সিনড্রোম দেখা দেয়।
মারা যাওয়া ২৫ শতাংশই শিশু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ১২ হাজার ৯৫৪ রোগী শনাক্ত হয়েছেন, এর ৩৫ শতাংশই শিশু। শুধু ঢাকা বিভাগে আড়াই হাজার শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৭৩ জন, এর ২৫ শতাংশই শিশু। আর জুলাইয়ের প্রথম ৯ দিনে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে শিশু ছিল ১৪ হাজার ৯৭২ জন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা যান গত বছর, ২৮১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালে ৭ জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।
গতকাল ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ছয়জনের মধ্যে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ফারজানা আনোয়ার। তিনি রাজধানীর বানানীতে বাস করতেন। গত রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।