হাজার বছরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত শবেকদর

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:৩৫, রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৩, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ

মুসলমানদের কাছে লাইলাতুল কদর এক বরকতময় ও মহিমান্বিত রাত কারণ এ রাতে আল্লাহতায়ালা কুরআনে কারিম নাজিল করেছেন এবং এ রাতের নামে আল্লাহতায়ালা একটি সূরাই নাজিল করেছেন। এ রাতের মর্যাদা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। আল্লাহতায়ালা বলেন

আমি ইহা নাজিল করেছি এক সম্মানিত (শবেকদর) রাতে। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? লাইলাতুল কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশ ক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

লাইলাতুল কদরের ইতিহাস

তাফসিরে ইবনে কাসিরে এসেছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার বনি ইসরাইলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেনি। মুসলমানরা এ কথা শুনে অবাক হলে এ সূরা নাজিল হয়। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাতের ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

ইবনে জারীর (রহ.) বলেন-বনি ইসরাইলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তিসব রাতে ইবাদতে মশগুল থাকত ও সকাল হলেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেত এবং সারা দিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। সে এক হাজার মাস এ ভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহতায়ালা সূরা কদর নাজিল করে উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।

তাফসিরে মাজহারিতে এসেছে-শবেকদর উম্মতে মুহাম্মদীর একটা বৈশিষ্ট্য।

লাইলাতুল কদরের ফজিলত

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন। যে কদরের রাতে ইমান ও সওয়াবের নিয়তে নামাজ পড়ে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।

অন্য বর্ণনায় আছে, ভবিষ্যৎ এসব গুনাহও মাফ করে দেওয়া হয়। ওবাদাহ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-‘যে কদরের রাতের অন্বেষণে সেই রাতে নামাজ পড়ে এবং তা পেয়ে যায়, তার অতীতের ও ভবিষ্যতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’। (নাসাঈ)।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানে এমন এক রাত আছে যার ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। যে এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে অবশ্য বঞ্চিতের কাতারে আছে। (নাসাঈ ও মুসনাদ)।

ফেরেশতা নাজিলের রাত লাইলাতুল কদর

এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে-এখানে রুহ দ্বারা জিবরাইল (আ.) কে বুঝানো হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন কদরের রাত হয় তখন জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের দলসহ দুনিয়াতে অবতীর্ণ হন এবং আল্লাহর প্রত্যেক বান্দার জন্য দোয়া করেন যারা দাঁড়িয়ে বা বসে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন। কেও কওে বলেন, ফেরেশতারা আসেন ‘ফিহা ইউফরকু কুল্লু আমরিন হাকীম’ আবার তাফসিরে মাযহারিতে এসেছে ফেরেশতারা প্রত্যেক শান্তি ও কল্যাণকর বিষয় নিয়ে আসেন।

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কদরের রাতে পৃথিবীতে ফেরেশতার সংখ্যা পাথর কণার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। ফলে জমিনে শয়তানের রাজত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং সেই রাতে লোকেরা শয়তানের ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে।

লাইলাতুল কদর কবে

কুরআনুল কারিমের বর্ণনা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, শবে কদর রমজান মাসেই। কিন্তু এর সঠিক কোনো তারিখ জানা যায়নি। তাফসিরে মাজহারিতে শবেকদর সম্পর্কে সহিহ আল বুখারির একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়, শবেকদর রামজান মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যেই আসে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা রামজানের শেষ দশকে শবেকদর তালাশ করবে। আর ইমাম মুসলিম (রহ.) তার সহিহ মুসলিম শরিফে বলেন, শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে তালাশ কর।

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘কিছু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম রমজানের শেষ ৭ দিনে কদরের রাতকে স্বপ্নে দেখেন। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমিও তোমাদের মতো রমজানের শেষ ৭ দিনের মধ্যে কদরের রাতকে স্বপ্নে দেখেছি। কেউ কদরের রাত তালাশ করতে চাইলে সে যেন শেষ ৭ দিনের মধ্যে তা করে।’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।

আব্দুল্লাহ বিন ওমর থেকে বর্ণিত, রাসুলূল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত তালাশ কর। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল ও অক্ষম হয় তা যেন শেষ ৭ দিনের ওপর প্রভাব বিস্তার না করে।’ (মুসলিম)।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি একজন বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি। আমার জন্য রাতের নামাজ খুব কষ্টকর। আমাকে এমন এক রাতের আদেশ দিন যে রাত হবে কদরের রাত। তিনি বলেন, তুমি ২৭ রমজানের রাতকে আঁকড়ে ধর।’ (মুসনাদে আহমদ)। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কদরের রাত তালাশ করে সে যেন ২৭ রমজানে তা তালাশ করে। (মুসনাদে আহমদ)।

লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক শুরু হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) কদরের রাত লাভের উদ্দেশ্যে পূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন, রাত জাগরণ করতেন এবং নিজ পরিবারের জাগাতেন।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে এত বেশি পরিশ্রম ও ইবাদত করতেন যা অন্য সময় করতেন না। তিনি রমজানের শেষ দশককে এমন কিছু নেক কাজের জন্য নির্দিষ্ট করতেন যা মাসের অবশিষ্টাংশের জন্য করতেন না। এর মধ্যে রাত্রি জাগরণ অন্যতম। (মুসলিম)।

লাইলাতুল কদরের আলামত

এই দিনে সূর্য উদিত হবে কিন্তু তার তাপ থাকবে না ।

এই রাতের ইবাদত বন্দেগি অন্য দিনের ইবাদত বন্দেগির তুলনায় অধিক একাগ্রতার সঙ্গে সাধিত হবে।

এ রাতে সব সৃষ্টিজীব আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে সিজদায় পতিত হবে।

প্রত্যেক স্থানে নুরের জ্যোতি চমকাতে থাকবে। অন্ধকারেও তা বিদ্যমান থাকবে।

লাইলাতুল কদরের আমল

লাইলাতুল কদর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। তাই বিভিন্ন আমলের মাধ্যমে এ রাতটি অতিবাহিত করা উচিত।

বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত।

অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করা উচিত।

অধিক পরিমাণে জিকির আজকার করা উচিত।

বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করা উচিত। তবে কত রাকাত আদায় করতে হবে বা কোনো সূরা দিয়ে সালাত আদায় করতে হবে তার কোনো নির্দিষ্ট দলিল নেই। যত রাকাত ইচ্ছা এবং যে কোনো সূরা দিয়ে ইচ্ছা পড়া যায়। এমনকি নফল নামাজের জন্য কোনো নিয়তও নেই।

বেশি বেশি দোয়া করা উচিত। কারণ এ রাতে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি হুযুর (সা.) কে আরজ করলাম, হে আল্লাহর নবি! আপনি বলে দিন যদি আমি জানতে পারি যে, শবেকদর কোন রাতে হবে, তাতে আমি কী বলব? রাসূল (সা.) বললেন তুমি বলবে, হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাস। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

সালাতুত তাসবিহ-এর নামাজ পড়া।

তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া।

লেখক : খতিব, বাইতুল মামুর জামে মসজিদ, উত্তরা ১২ নং সেক্টর, ঢাকা

Share This Article